মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি চমকের নাম হচ্ছে জলপাই তেল। তিউনিসিয়ায় এক কিলো বিশুদ্ধ জলপাই তেলের মূল্য গতবছরের তুলনায় এ বছর শতভাগ বেড়েছে। অন্যদিকে তুরস্কে এটার চাহিদা এত ব্যাপক যে, সরকার প্রতি কিলো জলপাই তেল রপ্তানির ওপর ২০ সেন্ট কর আরোপ করেছে।
লেবাননে ছোট খাটো ব্যবসায়ীরাও জলপাই তেলের বিশাল চাহিদা দেখছে। এমাসের শুরুর দিকে একটা স্প্যানিশ কোম্পানি মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে আসে। সেসময় তারা স্থানীয় সমস্ত মজুদ পণ্য পাইকারি দরে কিনে নেয়। এর ফলে পরবর্তীতে লেবাননের স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো তাদের নিজেদের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সংকটের মুখে পড়ে যায়।
ফেয়ার ট্রেড লেবাননের প্রজেক্ট ডিরেক্টর ক্রিশ্চিয়ান কামেল মিডিলইস্ট আই-কে বলেন, আজ যদি আমেরিকা বা ইউরোপ থেকে বড় কোনো অর্ডার আসে তাহলে আমরা সেটা দিতে পারবো না, এর কারণ, স্প্যানিশরা আমাদের জলপাই তেলের রিজার্ভ শূন্য করে দিয়েছে।
দক্ষিণ ইউরোপে চলমান তাপদাহের ফলে দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। স্পেন তীব্র খরায় জর্জরিত, অথচ এই স্পেনে সারা বিশ্বের অর্ধেক জলপাই তেল উৎপাদিত হতো। যেখানে দেশটি সচরাচর ১৫ লাখ টন জলপাই তেল উৎপাদন করে, সেখানে এ বছর ৬ লাখ ২০ হাজার টন উৎপাদন করেছে। এই অবস্থায় ইউরোপীয় উৎপাদনকারীরা তাদের চাহিদা মেটাতে তিউনিশিয়ার দিকে ঝুঁকছেন। তিউনিশিয়া আরব দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ জলপাই তেল উৎপাদন করে।
তিউনিসিয়া তার জলপাই তেলের ৯০ ভাগই ইতালি ও স্পেনের মত দেশগুলোতে বিক্রি করে। সেখানে তারা এটি অন্য তেলের সাথে মিশিয়ে ইতালিয় বা স্প্যানিশ লেবেল লাগিয়ে বহির্বিশ্বে বিক্রি করে। দেশটিতে এ বছর অন্যান্য বছরগুলির তুলনায় ফসল উৎপাদন একটু কম হলেও ব্যাপক বাজার চাহিদা থাকায় রপ্তানি রাজস্ব ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। পরবর্তী বছরে রপ্তানি বেড়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন থেকে ২ লাখ মেট্রিক টন হবে যা পূর্বের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ।
তিউনিশিয়ার জলপাই তেল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বুলা রেজিয়ার মার্কেটিং ম্যানেজার ফাহদ বেন আমর মিডিলইস্ট আইকে বলেন, ‘তিউনিশিয়ার জলপাই গাছগুলো স্প্যানিশ গাছগুলোর চেয়ে বেশি খরা সহনশীল জাত। এদিকে ইউরোপে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে আশংকা করা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে সম্ভবত জলপাই তেলের একটা সংকট সৃষ্টি হবে।
তেলবীজ ও ভোজ্যতেল বিশেষজ্ঞ কাইল হল্যান্ডের ভাষায়, ‘অক্টোবর- নভেম্বর মাসে যদি আসেন তাহলে স্প্যানিশ জলপাই তেলের একটা সংকট দেখতে পারবেন। এই সংকট এড়ানোর জন্যই কোম্পানিগুলো জলপাই তেলের জন্য অন্যান্য অঞ্চলমুখী হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, স্পেনে জলপাই তেল উৎপাদন কম হওয়ায় তা অন্যদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের গাছগুলোতে ইউরোপের মত পানি দেওয়া লাগে না
লেবাননের কৃষিজমির ২৩ শতাংশই হলো জলপাই গাছ। কিন্তু জলপাই উৎপাদন হয় মূলত পারিবারিক মালিকানাধীন ছোট খাবারগুলো থেকে। যার জন্য এখানে ফলন তিউনিশিয়ার তুলনায় কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে লেবানন ১৫০০ মেট্রিক টন জলপাই তেল উৎপাৎন করেছে।
কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয় অন্য অঞ্চলের মতো লেবাননের ফসলের ওপর খরার প্রভাব পড়েনি। চার প্রজন্ম ধরে জলপাই খামার চালানো আসাদ সাদেহ বলেন, ‘লেবাননের জলপাই গাছগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।’ তিন বছর আগে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে জলপাই তেল রপ্তানি শুরু করেন বলেও জানান।
লেবানন বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রার মান ৯৫ শতাংশ কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও সাদের ভাষায়, ‘লেবাননের একটা সুবিধা আছে আর সেটা হলো, ইউরোপে জলপাই প্রকল্পে সেচ দিতে হয় কিন্তু তাদের এগুলোর প্রয়োজন হয় না।’
লেবাননের লেভান্ত অঞ্চলের দেশ যাকে আরবিতে বিলাদ আল-শাম বলা হয়। সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলও এই অঞ্চলে অবস্থিত। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সিরিয়ার জলপাই শিল্প সারা বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে সিরিয়া ১ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন জলপাই তেল উৎপাদন করে। সেগুলো মূলত তুরস্কে রপ্তানি করা হয়।
লেভান্তের দেশগুলোর জলপাই তেল উৎপাদনের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। কিন্তু এখন পর্যন্ত খুব কম দেশই তাদের উৎপাদিত পণ্য উন্নত দেশের বাজারে রপ্তানি করতে পেরেছে। এর একটি বড় কারণ হলো- এখানকার খামারগুলো পারিবারিকভাবে চলে। তিউনিশিয়া বা স্পেনের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা তাদের নেই। এমনকি গ্রিস বা ইতালির মতো ব্রান্ড ভ্যালুও তাদের নেই। তুরস্কের জলপাই তেল রপ্তানিকারকদের জন্য এ বিষয়টি সত্য। তুরস্কে গতবছর রেকর্ড পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন জলপাই উৎপাদন হয়।
দায়গু ওযারসন ইলাকদার নামে এক জলপাই তেল উৎপাদনকারী মিডিল ইস্ট আই-কে বলেন, ‘যখন আমি আমার জলপাই তেল বাইরে রপ্তানি করি, আমাকে প্রতিযোগিতামূলক দামে তা ছাড়তে হয়। গ্রিস বা ইতালির তুলনায় আমার লভ্যাংশও কম।’ ৬০ হাজার জলপাই গাছের মালিক ইলাকদার আরো বলেন, ইউরোপীয়রা আমাদের এখানে জলপাই কিনতে আসে। এই সময়ে ইউরোপের গাছগুলোতে জলপাই থাকে না। আমরা দাম বেশি রাখি কারন, তাদেরকে আমাদের থেকেই এগুলো কিনতে হবে।
ইলাকদার আরো বলেন, ‘এক কেজি জলপাই তেলের মূল্য বছরের শুরুতে যা ছিল তার তুলনায় এখন দ্বিগুণ। জলপাই তেল বর্তমানে স্বর্ণের মতো হয়ে গেছে।’
জর্ডানের উৎপাদনকারীদের জন্য জলপাই তেলের এই উচ্চ দাম এমন সময়ে এসেছে যখন, চারটি প্রধান খামারের একটি সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ব্যক্তিগত লেবেল চালু করার পরিকল্পনা করছে৷ এই খামারগুলোর মধ্যে একটি আবার জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহর মালিকানাধীন।
জর্ডানে তুলনামূলকভাবে কম জলপাই তেল উৎপাদিত হয়। প্রতিবছর গড়ে ২৫ হাজার মেট্রিকটন তেল উৎপন্ন হয় যার সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হয়। এ অঞ্চলের একজন বড় জলপাই তেল রপ্তানিকারক ও জর্ডানের আলজুদ ফার্মের মালিক নিদাল সামাইন বলেন, ‘জর্ডানের জলপাই তেল শিল্প জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।’
এখানে উল্লেখ্য, দেশটি বিশ্বের অন্যতম পানি সংকটের ভুক্তভোগী দেশ। ফার্মমালিক নিদাল বলেন, জর্ডানের অলিভ তেল খুব বেশি দামে বিক্রি হয়। এগুলো সব প্রিমিয়াম ধরনের। সুতরাং, ইউরোপে উৎপাদন কমে যাওয়া জর্ডানের জন্য একটি আশির্বাদ। এটি আমাদের জন্য ভালো।
নিদাল সামাইন আরও বলেন, খরার জন্য আমাদের নাবালি (জলপাই গাছের একটা প্রজাতি) জলপাই গাছগুলো উপযুক্ত। এগুলো মরুভূমির মতো জায়গায় ভালো ফলে। জর্ডানের সবচেয়ে ভালো মানের জলপাই তেল এই মরুভূমি অঞ্চলে উৎপাদিত হয়।
দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে জলপাই তেলের এই উচ্চ মূল্যে রপ্তানি যেন আশার আলো দেখাচ্ছে। জর্ডানে বেকারত্ব একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটি এখন পর্যন্ত আমেরিকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে চলছে।
অন্যদিকে তুরস্ক মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত। মুদ্রাস্ফীতির কারণে তুরস্কের জলপাই তেল তুলনামূলকভাবে অন্যদের তুলনায় সস্তা। লিরার মূল্য কমে যাওয়াতে উৎপাদনকারীদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের সরকারও চেষ্টা করছে বেসরকারিভাবে রপ্তানি বাড়াতে।
জলপাই তেল উৎপাদনকারী ইলাকদার বলেন, বহির্বিশ্বের দেশগুলোতে তিনি তার রপ্তানি আরো বাড়াতে চান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ৭০ ভাগ তেল দেশীয় বাজারে এবং ৩০ ভাগ বাইরে রপ্তানি হয়। আমি চাই এটা উল্টো হোক।’
মিডলইস্ট আই থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন এমদাদুল হক
© 2023 | All Right Reserved | Developed By WebGet