বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ঘটে যাওয়া নানাবিধ ঘটনা আমরা মুহূর্তেই জানতে পারি। যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গতকাল ভাইরাল হওয়া পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক অ্যান লিয়ের ঘটনাটি। নোবেল পুরস্কার কমিটি যখন তাকে ফোন করে জানায়, তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দেন, ‘তিনি ব্যস্ত এবং ক্লাস নিচ্ছেন।’ নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হয়েছেন জেনেও তিনি নির্লিপ্ত থেকে সম্পূর্ণ ক্লাস শেষ করেছেন।
এই ঘটনার পূর্বে ফিরে যাই শত বছরের কিছু আগে। ১৯১৩ সালে যে বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল পুরস্কারের খবর জানার পর কবিগুরুর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল সেটিও বর্তমান প্রজন্মের জানা দরকার। তখন মোবাইল ফোন ছিল না, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও আবিষ্কার হয়নি। ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর যে দিনটিতে নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কারের খবরটি দেয় সেদিন রবীন্দ্রনাথকে ফোন করা হয়নি বরং টেলিগ্রাম পাঠানো হয় লন্ডন থেকে ৬নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের ঠিকানায়। রবীন্দ্রনাথ তখন বোলপুরের শান্তিনিকেতনে। ১৫ নভেম্বর মধ্যেরাতে জোড়াসাঁকোয় পৌঁছায় নোবেল প্রাপ্তির টেলিগ্রাম। কবির ছোট জামাই টেলিগ্রাম পেয়ে সে রাতে ঘুমোতে পারেননি কখন সকাল হবে সেই প্রতীক্ষায়। সকালের আলো ফুটতেই দ্রুত ডাকঘরে পৌঁছে টেলিগ্রাম পাঠালেন কবিগুরুর বোলপুরের ঠিকানায়। কিন্তু সে টেলিগ্রাম পৌঁছানোর আগে কবির এক সুহৃদ অন্য আরেকটি টেলিগ্রাম পাঠান। সেটিই রবীন্দ্রনাথ প্রথম পাঠ করেন।
রবীন্দ্রনাথ সেদিন বোলপুরে মোটরগাড়িতে চড়ে কয়েকজন বিদেশি অতিথি, ছেলে রথীন্দ্র আর সচিব নেপালচন্দ্রকে নিয়ে বনবিহারে বের হন। পথিমধ্যে দেখা হয় বোলপুরের ডাকপিয়নের সাথে। কবি গাড়ি থামিয়ে প্রশ্ন করেন কোনো সংবাদ আছে কি? এরপর কলকাতা থেকে আসা তারখানা হাতে দেয় ডাকপিয়ন। কবি তখনও পড়লেন না টেলিগ্রামের কাগজ। রেখে দিলেন জোব্বার পকেটে। কিন্তু সকলের কৌতুহল নিবারনে খুলতে হলো কাগজ। সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে আবীর মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ‘জোব্বার পকেট থেকে টেলিগ্রামের কাগজ বের করলেন কবি। ভাঁজ খুলে বার দুয়েক পড়লেন। চেয়ে রইলেন বনপথে, উদাস করা চাহনি। তারপর উদাসীনভাবে নোবেল প্রাপ্তির টেলিগ্রামটা সচিবের দিকে এগিয়ে বললেন, নিন নেপালবাবু। এই আপনার ড্রেন তৈরির টাকা।’ উল্লেখ্য, তখন শান্তিনিকেতনে পানি সরবরাহের জন্য ড্রেন তৈরির কাজ চলছিল।
মহত্তম ব্যক্তি বুঝি একেই বলে! অথচ অন্য কেউ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে শুনলে কি কাণ্ডটাই না করতেন। প্রগাড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলেই সম্ভব হয়েছে এতবড় খবর এমনতভাবে গ্রহণ করা। তবে এটা সত্য যে, যারা সমাজের জন্য, মানুষের জন্য স্বার্থ ছাড়াই কাজ করেন, নোবেল পুরস্কার হোক কিংবা তার থেকেও বড় কোনো পুরস্কার; সেটা তাদের ভাবাবেগের পরিবর্তন ঘটায় না।
লেখক : প্রভাষক
গ্রীন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
© 2023 | All Right Reserved | Developed By WebGet