যখন এই লেখাটা শুরু করলাম ইংল্যান্ডে ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২.০৪ মিনিট, বাংলাদেশে সময় ভোর ৫.০৪। বছর ঘুরে ১২ অক্টোবর চলে আসল আবার। গত বছর এই তারিখ টা আমার জীবনে অনেক আনন্দের একটা দিন হওয়ার কথা থাকলেও, দিন শেষে অনেক বিভীষিকাময় একটা দিনে পরিণত হয়।
গত বছর এই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা বোর্ড ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, আমার বিশ্ববিদ্যালয়; পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ, আমার বিভাগ, যেই বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্রী ছিলাম আমি, সবসময় সবজায়গায় নিজের কাজ আর পরিশ্রম দ্বারা যেই বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করেছি অথবা করার চেষ্টা করেছি আমি—সেই জায়গাতেই দিনশেষে অযোগ্য বিবেচিত হয়েছিলাম আমি। গত ৩৬৫ দিনে এমন দিন খুব কমই আছে যেদিন আমার এটা মনে হয়নি অথবা এটা মনে করে আমি কষ্ট পাইনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসেবে চাকরি শুরু করি আমি। এখানে অবশ্য গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত কাজ করেছি; মাঝে আইসিডিডিয়আরবিতে চার মাস সিনিয়র রিসার্চ অফিসার হিসেবে কাজ করেছিলাম। কিন্তু আমার ধ্যান-জ্ঞান ছিল শিক্ষক হওয়া, একদম সেই ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষ থেকে।
যারা আমাকে চিনেন অথবা জানেন তাদের এই ব্যাপার টা জানা। তাই ২০২১ সালে জাবিতে পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের সার্কুলার হওয়ার সাথে সাথেই এপ্লাই করি। বিভিন্ন কারণে সেই বোর্ড অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে, ১ বছর পরে। সেদিনের সেই বোর্ড নিয়ে অনেক উচ্চাশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল আমার মাঝে, কারণ গত প্রায় ৮ বছর ধরে আমি আমার নিজেকে এই একটা জিনিসের জন্য তৈরি করেছিলাম, নিজের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হিসেবে নিজেকে দেখা, নিজের যৎসামান্য মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে এই ডিপার্টমেন্টকে এক অনন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া।
তাইতো মাস্টার্স শেষ করার পরও ডিপার্টমেন্ট এর যেকোন কাজে যখনই কোন শিক্ষক ডেকেছেন, নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সেটা করেছি, আর তার ফলাফল ও পেয়েছি। এর মাঝে দু’টা উদাহরণ দিতে চাই, গতবছর জাবির পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে দু’টি ফান্ড পায়, এর মাঝে একটি ছিল ৫০ লক্ষ টাকার প্রজেক্ট, যেটির প্রটোকল লেখার অংশ ছিলাম আমি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ টোবাকো কন্ট্রোল রিসার্চ গ্র্যান্ট পায় পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ, যেটির পুরো প্রটোকল এককভাবে লিখেছিলাম আমি। ৯-৫ টা অফিস করে রাতে বাসায় ফিরে প্রটোকল লিখতাম, যাহোক সেসব অন্যকোন জায়গায় বলা যাবে।
আমার এত পরিশ্রম, এত ডেডিকেশনের কারণ ছিল একটাই আমার নিজের ডিপার্টমেন্ট এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেখানে সবাই এক নামে চিনবে, আর বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবে এই কাজ করা আমার জন্য অনেক সহজ হতো। আর তাই গত বছরের এই দিনের শিক্ষক নিয়োগ ভাইভা আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ভাইভার দিন যথাসময়ে ভিসি অফিসে উপস্থিত হয়েছিলাম। আমার ভাইভার সিরিয়াল ছিল সবার শেষে। যখন সবার শেষে আমার ডাক আসল তখন ভিসি স্যারের রুমে উপস্থিত হলাম। সেখানে দুইজন এক্সটার্নাল (একজন অনলাইনে), ভিসি স্যার আর পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। আমি গিয়ে বসার পরে এক্সটার্নাল স্যাররা আমার গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, সেখান থেকে প্রাসঙ্গিকভাবে পরিসংখ্যান এর বিভিন্ন বিষয়, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করলেন—সবগুলোর উত্তরই কনফিডেন্টলি সঠিকভাবে দিতে পেরেছিলাম আমি।
সবশেষে ভিসি স্যার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করলেন উনার কোনো প্রশ্ন আছে কিনা। তখন ম্যাডাম আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন যেমন, আমি যদি শিক্ষক হই তাহলে কেমন শিক্ষক হতে চাই, আমার নিজের কাছে আমার পজিটিভ আর নেগেটিভ সাইড কোনগুলো এসব। আমিও প্রাসঙ্গিক উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি। পরবর্তীতে উনি যেই প্রশ্নগুলো করা শুরু করলেন সেটার জন্য আমি কেন পুরো ভাইভা বোর্ডের কেউই মনে হয় প্রস্তুত ছিলেন না। ওনার পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, ‘তুমি ডিপার্টমেন্টে কতদিন আসছো সার্কুলার হওয়ার পরে?’, ‘কতদিন সময় দিছ ডিপার্টমেন্টে?’ আমার প্রথমে বুঝতে কিছু অসুবিধা হচ্ছিল যে উনি আসলে কী বলছেন, কিন্তু নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করার পরে উনি আবার বলা শুরু করলেন, (এবার ভিসি স্যার কে উদ্দেশ্য করে)-
‘স্যার ও ডিপার্টমেন্টে আসে না, ডিপার্টমেন্টে সময় দেয় না। ওর এক একটা পেপার পাবলিশ হয় আর ও আমাকে ইমেইল করে। আমি ওকে ইমেইলে বলি তুমি আসো ডিপার্টমেন্টে সময় দাও। ও আমাকে জানায় ও আসবে, পরে আসে না (যদিও এটা একটা ভুল কথা ছিল)। অন্যান্য ক্যান্ডিডেটদের তুলনায় তুমি কয়দিন আসছ, আফিফা? আমি হাতে গুণে বলে দিতে পারব ৩ দিন আসছ।’
তখন আমার অবস্থা অনেকটা খাবি খাওয়া মাছের মতো। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না এ অবস্থায় কী কথা বলা যায়, কারণ আমার জানা ছিল একটা সার্কুলার হওয়ার পরে একজন ক্যান্ডিডেট হিসেবে ডিপার্টমেন্টে আসা বা শিক্ষকদের সাথে পার্সোনাল কন্টাক্ট করাটা আনইথিক্যাল। তারপরও বিভিন্ন সময়ে আমি চেষ্টা করেছি ডিপার্টমেন্টে আসার, এমনকি আমার শ্বশুর হাসপাতালে ছিলেন সে সময়ও আমি ডিপার্টমেন্টে এসেছিলাম শুধুমাত্র ‘সময় দিতে’।
যাইহোক, আমি উনার প্রশ্নের উত্তরে শুধু এতটুকু বলেছিলাম যে, ‘ম্যাডাম, আমি তো চাকরি করি, আমার কাজের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে, দায়বদ্ধতা আছে, তাই আমার পক্ষে অন্যদের মতো এতবার আসা সম্ভব হয় না। আমি যেখানেই কাজ করি চেষ্টা করি আমার ১০০ ভাগ দিয়ে পারফেক্টভাবে কাজটা করতে। আর তাই গতকাল ও বিকেল ৪.০০ টা পর্যন্ত অফিস করে তারপরে বাসায় গিয়েছি, আজকে ভাইভা দিতে এসেছি। আর তাই আমি আপনাকে বলতে পারি আমাকে সহকর্মী হিসেবে পেলে আমার কাজ নিয়ে আপনার কোনো অভিযোগ থাকবে না।'
আমার এই কথা শুনে একজন এক্সটার্নাল স্যার বললেন, ‘আফিফা, তুমিতো দায়বদ্ধতার কথা বললে, কিন্তু এখানে তো সবাই খুব স্বাধীন, কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই। সেখানে তুমি কী করবে?’ স্যারের প্রশ্নের উত্তরে আমি এতটুকুই বলেছিলাম যে, ‘স্যার তাহলে একটু ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডে যেতে হয়। আমার মা-বাবা দু’জনেই শিক্ষক, তাই ছোটবেলা থেকেই এমন একটা ইথিক্যাল পরিবেশে আমি বড় হয়েছি যেখানে কর্মক্ষেত্রে জবাবদিহিতা আর দায়বদ্ধতা খুব কঠোরতার সাথে মানা হয়।’ এরপরে ভিসি স্যার এবং এক্সটার্নাল স্যাররা জানতে চাইলেন আমার আব্বু-আম্মু কোথায় আছেন, কী করেন এসব। আর তারপরে আমার ভাইভা শেষ হয়।
আমার ভাইভা শেষ হওয়ার পরে শুনেছি চেয়ারম্যান ম্যাডাম দুইঘণ্টা ভিসি স্যারের সাথে কথা বলেছেন আমাকে যেন না নেওয়া হয় সে ব্যাপারে। আমার ব্যাপারে টিচারদের রিসারভেশন আছে, আমি উদ্ধত, আমি ডিপার্টমেন্টে সময় দেই না—এইসব বলেছিলেন উনি। এসব অবশ্য আমি পরে জানতে পারি। সিক্সথ সেন্স ব্যাপারটা নাকি মেয়েদের প্রবল হয় আর তাই হয়তো ঐদিন ই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক হিসেবে আসা আমার হবে না। পরবর্তীতে এটাও জানতে পেরেছি যে একজন শিক্ষক এটাও বলেছিলেন যে, ‘আফিফা তো সাহাদাতের বউ, আমরা হাসবেন্ড-ওয়াইফ-কে একসাথে নেই না।’ যেই জায়গাটাকে আমি আমার নিজের বলে বিশ্বাস করতাম, সবসময়, সবজায়গায় চেষ্টা করেছি নিজের ডিপার্টমেন্ট কে বড় করার, সেই জায়গাটা নিমেষের মাঝে আমার পর হয়ে গেল, সেখানকার মানুষগুলো আমাকে পর করে দিল! আমার বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ—
১। আমি ডিপার্টমেন্টে সময় দেই না
২। আমি সাহাদাতের বউ
৩। আমি উদ্ধত
৪। আমার বিরুদ্ধে টিচারদের রিজারভেশন আছে
সেই বোর্ডে রেজাল্ট (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দু’টিতেই ১ম স্থান), পাবলিকেশন (১৪টি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র), রিসার্চ গ্র্যান্ট (৩টি- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক), এক্সট্রাকারিকুলার এক্টিভিটিস ইত্যাদি একাডেমিক যোগ্যতার বিচারের সকল মানদন্ডে ওই বোর্ডে অংশগ্রহণকারী সকল ক্যান্ডিডেটের তুলনায় এগিয়ে থাকার পরেও যখন আমি ‘অযোগ্য’ হিসেবে বিবেচিত হলাম, তারপরে আমার রিয়েলাইজেশন হল—
১। আমার ডিপার্টমেন্টে আমি একজন প্রাক্তন ছাত্রীর পরিবর্তে হয়ে গেছি একজন শিক্ষকের বউ!
২। আমার ইন্টেলেকচুয়াল কন্ট্রিবিউশন আমার ডিপার্টমেন্টের জন্য কোন কন্ট্রিবিউশন না, যতক্ষণ না আমি যেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিপার্টমেন্টে ‘সময়’ দিচ্ছি (পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম এই সময় দেয়া বলতে আসলে কী বুঝায়)।
৩। এখন পর্যন্ত জ্ঞানত কখনো কোনদিন কোন শিক্ষকের সাথে উদ্ধত আচরণ করেছি বলে মনে পড়ে না, তারপর ও এই মিথ্যা অপবাদ আমাকে দেয়া হয়েছিল।
এই ঘটনার পরে আমাকে বিভিন্ন জন বলেছিল, কোনো স্টেপ নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি কিচ্ছু করিনি, এমনকি গত এক বছরে প্রকাশ্যে কোনো কথাও বলিনি। আমি মেনে নিয়েছিলাম রিজিকের মালিক আল্লাহ। আর আল্লাহ আমার রিজিক এখানে লিখে রাখেননি তাই এখানে আমার চাকরি হয়নি। কিন্তু আল্লাহ তো এটাও বলেছেন মজলুমের দোয়া আল্লাহ সরাসরি কবুল করেন আর বান্দার হক এমন একটা জিনিস যেটা আল্লাহর ও এখতিয়াররের বাহিরে। তাই আমি আল্লাহর কাছেই বলেছিলাম। কিন্তু আজকে ১ বছর পরে কেন লিখলাম এত কিছু? - কারণ দেখছিলাম যে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এটাকে নিয়ে ব্যাখা-অপব্যাখা দিয়েই যাচ্ছে। তাই আমার নিজের ই মনে হলো এটা নিয়ে কথা বলা উচিত।
আজকে আমি যেখানে আছি সেখানে থেকে গত এক বছরের এই কষ্ট ভুলে যাওয়া উচিত, অন্তত আমার হাসবেন্ড তাই বলে। কিন্তু কিছু কিছু কষ্ট, দুঃখ আছে চাইলেও ভুলে যাওয়া যায় না। আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভাল আছি এখন, পার্সোনালি, প্রফেশনালি, কিন্তু তারপর ও জানি না কতদিন লাগবে আমার এই কষ্ট ভুলতে। এখন যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বসে বই পড়ি অথবা লন্ডনের রাস্তা ধরে হাঁটি হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় এসব কথা। আজকে এক বছর পরে আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করি আল্লাহ যেন আমাকে এই কষ্ট ভুলার ক্ষমতা দেন, আমার সামনের পথচলা অনেক সহজ করে দেন।
আমিন। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
লেখক : পিএইচডি গবেষক
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়
© 2023 | All Right Reserved | Developed By WebGet