সৌদি আরব কেন ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনকে সেইভাবে সমর্থন করছে না এইটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ‘সাহওয়া মুভমেন্ট’ বুঝতে হবে। অটোমান খিলাফতের পরবর্তী সময়টাও এজন্যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অটোমান খিলাফতের পতনের পর আবার পুনরুজ্জাগরণের জন্য মিশরে গড়ে ওঠে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’। এই সংগঠন খুব দ্রুত আরব বিশ্বে ব্যাপক প্রভাবশালী সংগঠনে পরিণত হয়। সেই সময় চলছিল সোভিয়েত বনাম আমেরিকার শীতল যুদ্ধ। তখন আরব বিশ্বে সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার। সেই জয়জয়কার ঠেকাতে ইসলামপন্থীদেরকে সহায়তা করার স্বীদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এইক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কাছের মিত্র হিসেবে উপসাগরীয় দেশগুলোও তাদেরকে সহায়তা করে। সে সময় মিশর, সিরিয়া এবং ইরাকের সরকার ইখওয়ানকে দমন -পীড়ন শুরু করলে সৌদি আরব তাদেরকে সহায়তা করে এবং নিজেদের দেশে আশ্রয় দেয়। বলা যায় সেই সময়ে সৌদি আরবের সরকার ছিল ইখওয়ানপন্থী দলগুলোর সবচেয়ে বড় মিত্র।
এই ইখওয়ান নেতৃত্বই শুরু করে ‘সাহওয়া মুভমেন্ট।’ এই ম্যুভমেন্ট মোটামুটি হেফাজতে ইসলামের মতো আর কি। জাস্ট পলিসি রিলেটেড বিষয়ে সরকারকে একটু চাপ দেওয়া। তাদের চাপের কারণেই সৌদি সরকার পশ্চিমা বিশ্বের ওপর তেল অবরোধ দেয়, উপসাগরীয় যুদ্ধে জড়ায়। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হলো ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরে। তখন এই ব্যাপারটা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব ফেলে। তখন কিছু হালকা বুদ্ধির লোক সৌদিতেও বিপ্লব করে ফেলবে এই ধরনের একটা ধারণা নিয়ে আসে। কিন্তু সেটা খুব বেশি সমস্যা না। এরপর নব্বইয়ের দশকে যখন সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ হয় তখন সৌদি আরব সাহওয়া মুভমেন্টকে আরো শক্তিশালী করে সোভিয়েত বিরোধিতার জন্য। কিন্তু আল্টিমেটলি যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয় তখন আসলে সৌদি-আমেরিকা কারো আর ইখওয়ানকে দরকার ছিল না। তখন সৌদি আরবে যেন কোনভাবেই ঝামেলা না হয় এজন্য সৌদি আরব সালাফি-মাদখালী আকিদা ব্যাপারটাকে প্রমোট করে। আকিদা নিয়ে বেশি ঝামেলা লাগায় কারণ ইরান হলো শিয়া রাষ্ট্র। তাদের আকিদায় সমস্যা আছে আর এই এক অস্ত্র দিয়েই সে মুসলিম বিশ্বের একক নেতা হতে পারবে। আর মাদখালি হলে তার রাষ্ট্রের প্রতি কোনো হুমকি তৈরি হয় না।
এরপর একাবিংশ শতাব্দির শুরুতেই শুরু হয় ‘ওয়ার অন টের'র। মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৌদিকে পুরোটা সময় সমস্যার মুখোমুখি হওয়া লেগেছে সব জায়গায়৷ তারা তখন কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু সেইটা হালে পানি পায় না। আর নিজেদের দেশে ব্রাদারহুডও ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। এরপরে আসলো আরব বসন্ত৷ আরব বসন্ত পুরোটাই ছিল ইখওয়ানের প্লান। তখন নিজেদের সিংহাসন এবং বিলাসবহুল জীবন চালু রাখার স্বার্থেই ইখওয়ানকে ধ্বংস করা সৌদি আরবের জন্যে অত্যাবশকীয় হয়ে ওঠে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র আসলে সেইটা হবে সৌদ পরিবারের জন্যে ক্ষতির কারণ। তারা তখন তিউনিসিয়ার সাবেক ডিক্টেটরকে আশ্রয় দেয় এবং আন- নাহদা-কে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। ইজরায়েলের সাথে হাত মিলিয়ে মিশরের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মুরসিকে সরিয়ে দেয়। মিশরে মুরসির বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনটা করেছিল সালাফিরা। আর পুরো আন্দোলনটা হয়েছে সৌদির প্লানে। লিবিয়ার মুক্তি আন্দোলন এবং সিরিয়াতে কিছুটা সাহায্য করেছিল। কিন্তু নিজেদের লোক রাখার ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহ থাকার কারণে সেটা সফল হয়নি। আর নিজ দেশের সাহওয়া মুভমেন্টের যারা নেতৃস্থানীয় ছিলেন তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। বাকিদেরকে জেলে পাঠানো হয়। ইখওয়ান কেন্দ্রিক সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। হামাসের যেসব নেতা তখন সৌদিতে ছিলেন তাদেরকে জেলে পাঠানো হয়। সে সময় কাতার যেহেতু ইখওয়ানপন্থীদেরকে সাহায্য করতো তাই কাতারকে অবরোধ দেওয়া হয়। কিন্তু কাতারের ওপর অবরোধ কাতারকে এক বিন্দুও ক্ষতি করতে না পারায় এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর রাজনীতিতে তুরস্কের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকায় কাতারের সাথে আবার বন্ধুত্ব তৈরি হয়।
অবশ্য এর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন মুহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএস৷ জাস্ট প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত খেলা খেলে তিনি যুবরাজ হয়েই ইরানকে সব জায়গাা থেকে সরানোর চিন্তা করেন, ইখওয়ানকে সরাসরি শত্রু বানান। ইয়েমেন যুদ্ধ করেন। এখন একটা ইখওয়ানপন্থী দল হিসেবে হামাসের সাথেও সৌদির সম্পর্ক খারাপ। সৌদির হিসাব হচ্ছে ইখওয়ান যদি প্রভাবশালী হয় তাহলে সৌদিতেও তারা আল সৌদ পরিবারের ভোগবিলাসের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আর কোথাও ইখওয়ানপন্থীরা যদি সফল হয় সেই প্রভাব তো পড়বেই। কিন্তু হঠাৎ পুরো পরিস্থিতি বদলে যায় ইউক্রেন যুদ্ধের পর। সৌদি আরব আর ইরানের ভেতর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। হামাসের প্রধান খালিদ মিশাল সৌদি আরব সফর করেন। কিন্তু এরপরেও সৌদি আরব চাপে পড়ে আব্রাহাম অ্যাকোর্ডে যোগ দিয়ে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হামাসের চলমান আক্রমণের পরে সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। এখন বাকিটা সময়ের অপেক্ষা৷ তবে সৌদি আরব হামাসকে ভবিষ্যতে অবশ্যই সমর্থন দিবে। কারণ, মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার সুযোগ সৌদি ছাড়বে না। কিন্তু হামাস সফল হলে যে সাহওয়া ম্যুভমেন্ট অনুপ্রেরণা পাবে না সেই রিস্কও নেওয়া কঠিন।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী আইন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
© 2023 | All Right Reserved | Developed By WebGet