১. প্রাচীন আমল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রামীণ জনপদের মানুষের বেড়ে ওঠা সবুজ সোনালী মাঠের অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমিতে। ফুল ফসলের সবুজ মাঠে বেড়ে ওঠা কৃষদের প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা ছিল ডাক ও খনার বচন। যা যুগ যুগ অতিবাহিত হয়ে এখনও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। তেমনি গ্রামীণ প্রবাদের অনেক কথা আছে যেগুলো আমাদের বাস্তব জীবনের বিশ্বাস ও বাস্তবতায় ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে। গ্রামে একটা প্রবাদ আছে- ‘পানি কাটলে কখনো দুই ভাগ হয় না’। এটা একটা চিরন্তন সত্যও বটে। তবে এটাও চিরন্তন সত্য যে পানি কাটলে যেমন দুই ভাগ হয় না, তেমনি পানি কোন কিছুকে কেটে দুই ভাগ করে দিতে পারে। তেমনি দুটি ভাগ হয়েছে বাংলার সবুজ বুক চিরে উত্তর বঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গ নামে দুটি অংশ। হিমালয়ে থেকে গঙ্গা নদীর গাঙ্গেয় প্রবাহের পদ্মা নামে মালদহ, মুর্শিদাবাদের তীর ঘেষে বঙ্গদেশের রাজশাহী ও চাপাইনবয়াবগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবেশ করে। কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে, সেই সাথে রেখে গেছে দুটি বিভাজন। যার সংযোগ হিসেবে গড়ে উঠছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। দ্বিদল এ সেতুর উপরে যান চলবে আর নীচ দিয়ে যাবে রেল
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগণ তিল ঠাহি আর নাহিরে,
ওগো আজ তোরা জাসনে ঘরের বাহিরে’
২০২২ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত দক্ষিণ বঙ্গের ২১টি জেলার প্রায় ৫ কোটি মানুষের জীবনের সাথে এই লাইনটা ওতোপ্রোতভাবে মিশে ছিল। কবি আষাঢ়ের কথা বললেও বছরের চৈত্র থেকে ভাদ্র পর্যন্ত পদ্মা নদীতে পাড়ি দিতে হলে তিনদিন আগে থেকে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যেতো। কখন আকাশ মেঘমুক্ত হবে, পশ্চিম আকাশে কাল বৈশাখীর ঝড়ের বেগে বাতাস প্রবাহিত হবে না, কখন সুর্যের আলো আকাশের মেঘ কেটে মনে আশার আলো সঞ্চার করবে আর এই সুযোগে সাহস করে উত্তাল প্রমত্ত পদ্মার বুকের ওপর দিয়ে ঢাকা পৌঁছাবো। প্রয়োজনের তাগিদে জীবন বাজী রেখে জীবনের টানে ছুটে আসতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে পদ্মার স্রোতে। নদী বক্ষে বিলীন হয়েছে হাজারো ঘর বাড়ি তেমনি জলের ঢেউয়ে ডুবে গেছে কত শত লঞ্চ, স্টিমার, ট্রলার, সি- বোর্ড।
২. পদ্মা নদীর পাশে ফরিদপুর জেলায় বাড়ি হওয়াতে প্রায় ১ যুগ ধরে নিয়মিত ঢাকায় যাওয়া-আসা হয়। ফরিদপুর বা ওই অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসার পথ তিনটি মুন্সিগঞ্জ মাওয়া ঘাট, দৌলতদিয়া - আরিচা ঘাট, গোপালগঞ্জ - কার্তিকপুর মৈনট ঘাট। এগুলোর কোনোটাই স্থলপথ নয়। এ কারণে নদীপথ পাড়ি দেওয়ার বিকল্প আমাদের দক্ষিণ বঙ্গের নেই। এ হিসেবে আমাদের স্মৃতির ঝুলিতে ভয়াবহ তিক্ত অভিজ্ঞতা কারোরই কম নয়। বলতে না পারার সুযোগে অনেকের গল্পগুলো প্রায় অজানা থেকে যাই। আমার অভিজ্ঞতা তেমন না থাকলেও প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দিয়ে দুবার যে জীবনের অন্তিম মুহূর্ত মনে হয়েছিল সেকথা স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়। সূর্যের কিরণ যখন ঠিক মাঝ আকাশে থেকে একটু পশ্চিমে হেলে পড়তো তখন ঘড়ির কাঁটার দিকে না তাকিয়ে বলে দেওয়া যেতো বাড়ি বা ঢাকা থেকে আজ আর যাত্রা করা যাচ্ছে না। কারণ, ঘাটে গিয়ে নদী পথ পাড়ি দেওয়ার আর কোনো যানবাহন পাওয়া যাবে না। আর ঝড়, বৃষ্টি বা বৈরী আবহাওয়ায় তো সেই সিদ্ধান্ত বলে দেয় খোলা আকাশের মেঘলা বাতাস। সেই কঠিন যাত্রা পথের ভয় মাথায় নিয়ে এখন আর নদী পাড়ি দিতে হয় না। ভয়ডর কাটিয়ে নদী ঢেউ না দেখেও এখন পদ্মা পাড়ি দেওয়ার অভূতপূর্ব একটা সাফল্য আমাদের হয়েছে। দিন বা রাতের ইমার্জেন্সি যেকোনো মুহূর্তে পদ্মাসেতু দিয়ে স্থলপথে ঢাকায় পৌঁছানোর সুযোগ হয়েছে।
৩. রাজনৈতিক রোষানল কাটিয়ে, দ্বন্দ্ব মিটিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর মতো দাতা ও ঋণদান সংস্থার অভিযোগ উপেক্ষা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় নেতৃত্বের এক অবিচলতার মূর্ত প্রতীক স্বপ্নের পদ্মাসেতু। সেই সাথে আরও একটি নতুন রেল সংযোগ যা রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণ বাংলার দূরত্ব যোজন-যোজন কাছে টেনে দিয়েছে। এখন পদ্মা পাড়ি দিতে আমাদেরকে আর পূর্ব আকাশের সূর্যোদয়ের দিকে তাকাতে হয় না, চোখ রাখতে হয় না বিকালের পশ্চিম আকাশে কিংবা কাল বৈশাখী ঝড়ো আবহাওয়ার দিকে। এসবের বাইরে গিয়ে যে অর্থনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত না করলে এ লেখা পূর্ণতাপাবে না। জাতীয় জিডিপিতে পদ্মা সেতু ১.২৩ শতাংশ এবং আঞ্চলিক জিডিপিতে ২.৩ শতাংশ অবদান রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন সহজ হবে ঢাকা, বরিশাল, যশোর ও খুলনা বিভাগের মধ্যে আন্তঃসংযোগ। সেই সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক আত্মমর্যাদার গুরুত্ব।
নিজস্ব অর্থায়নের মূর্ত প্রতীক পদ্মাসেতু। বাংলাদেশের পদ্মা সেতু একমাত্র মেগা প্রকল্প যেটি সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তোলা হয় যদিও রেলসেতু চীনের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের ব্লাকমেইলিং রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার নিজস্ব আত্মমর্যাদার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারের সেই তলাবিহীন ঝুড়ির গল্প এখন আমেরিকার জাদুঘর থেকেও হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
৪. উন্নয়নের সার্থকতা পাবে ন্যায্য ভাড়ায়। অর্থনীতির ভাষায় উপযোগ বা ভোগবাদ সাধারণত সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারকে বোঝায়। আর সেই সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশের প্রান্তিক অংশীজনদের মাথায় রেখে ট্রেনের একটা ন্যায্য ভাড়া বাস্তবায়ন হলে জনগণের আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণতা পাবে। ৬.১০ কি. মি সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে কয়েকগুণ বেশি কিলোমিটার। কমলাপুর থেকে ফরিদপুর ভাঙার দূরত্ব মাত্র ৭৭ কিলোমিটার যেখানে ভাড়া ধরা হয়েছে ৩৫৬ থেকে ৩৫৯ যা কিলোমিটার দূরত্ব বিবেচনায় বাস ভাড়ার চেয়েও বেশি। এটা যেন এক বালতি দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গরুর প্রস্রাব যা পুরো দুধের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আরও সুদৃষ্টি ও মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
© 2023 | All Right Reserved | Developed By WebGet