রোমাঞ্চকর ভ্রমণের বাঁকে বাঁকে চায়ের পিপাসা ও ভুনা দুম্বার সুবাস। আফগানরা অত্যন্তচা প্রিয়। শীত প্রধান দেশের লোকেরা সাধারণতচা-কফিতে আসক্ত হয়। রামনাথ বাংলাদেশের ছেলে হলেও ক্যাফেইন ভক্ত। আফগানিস্তানে তার এ ব্যাপারে কোন কষ্ট হয়নি। তবে চা পেলেও ওখানে কফির প্রচলন তেমন না থাকায় কফির তৃষ্ণা ভুলে থাকতে হয়েছিলো।
চলার পথে কোন অচেনা ঘরে আশ্রয় লাভের পরে মেজবানদের ফিসফিসানি, কিছু সময় বাদেই ভুনা দুম্বার সুগন্ধ। বইটিতে বার বারই এ দৃশ্য আসে। কদিনের অর্ধাহার ও শুষ্কতার পরে এরূপ উষ্ণ সুবাসে নবজীবন লাভ করে আবার বেরিয়ে পড়তে হয়।
আমাদের হবিগঞ্জের ছেলে প্রাচ্যের ইবনে বতুতা নামে খ্যাত পরিব্রাজক শ্রীরামনাথ বিশ্বাস ১৯৩৪ সালে আফগানিস্তান ভ্রমণে যান। তার বিশ্ব ভ্রমণের দ্বিতীয় দফার সূচনা হয়েছিলো আফগানিস্তান পর্যটনের মাধ্যমে। রামনাথ নিজের গড়াপর্যটন প্রকাশনার মাধ্যমে তার বিশ্বভ্রমণের ধারা বর্ণনা প্রকাশ করেন। সেই ভ্রমণ কিসসার আফগানিস্তান অংশকে ২০২২ সালের জানুয়ারীতে “বিপ্লবী বাঙালি রামনাথ বিশ্বাসের আফগানিস্তান ভ্রমণ” নামে প্রকাশ করে রেজায়ী সেন্টার, ঢাকা। চলতি সময়ের পাঠোপযোগী করতে বইটিতে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করেন রেজায়ী সেন্টারের পরিচালক শামীম রেজায়ী।
যেকোন জাতির বর্তমানকে ভালোভাবে বুঝতে হলে তার অতীতকেও জানা দরকার। আফগানিস্তান একটা বৈশ্বিক আলোচ্য বিষয়। প্রায় ১০০ বছর আগেরামনাথ বিশ্বাসের দেখা দেশটির চিত্র বর্তমান আফগানিস্তানকে বুঝতে খুবই সহায়ক। আফগান মানস, ওখানকার রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি ও প্রতিরক্ষার গোপন রহস্য বুঝতে রামনাথের পর্যবেক্ষণটা এখনও প্রাসঙ্গিক। শতাব্দীকাল আগের সাথে বর্তমানকে তুলনা করলে আমরা বহু ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকতা পেয়ে যাব।
রামনাথ বিশ্বাসের বিশ্বভ্রমণ ও আফগান পর্বের পটভূমি
১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারী হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণ পাড়ায় রামনাথ বিশ্বাসের জন্ম। তখন স্থানটি ভারতের অসম [আসাম] রাজ্যের সিলেট জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিছুটা বেড়ে উঠতেই রামনাথ বুঝতে পারেন তার মাতৃভূমি পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ। তিনি বিপ্লবী ধারার সংগঠনে যোগ দেন দেশকে স্বাধীণ করার সংকল্পে। পরে চাকরিসূত্রে ১৯২৪ সালে সিঙ্গাপুরে বসবাস শুরু করেন।
চাকরি করে নিরাপদ আয়েশী জীবন কাটানো তার জীবন উদ্দেশ্য ছিলোনা। মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার আশাও ভুলে যাননি। দেশে দেশে স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই সম্পর্কে ভালভাবে জানা এবং ভারতবাসী ও বিপ্লবী বাঙালিদের জানানো ও প্রেরণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রামনাথ বিশ্বভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিট থেকে বাইসাইকেলে যাত্রা শুরু করেন। কুইন স্ট্রিটে সমবেত প্রবাসী বাঙালিদের উষ্ণ বিদায় তার আত্নবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। আমরা বইটি দেখলে বুঝতে পারব সেকালে এভাবে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়ার জন্য কতটা উচ্চ আশা, স্বপ্ন ও সাহসের প্রয়োজন ছিলো।
৩টি পর্যায়ে এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার লড়াই নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা করেন রামনাথ বিশ্বাস। তার দ্বিতীয় পর্যায়ের ভ্রমণটি শুরু হয়েছিলো আফগানিস্তানের মাধ্যমে। তখন আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসা খুব সহজ হলেও ভারত থেকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া ছিলো খুবই দুঃসাধ্য। কাবুলিওয়ালারা অহরহ এদেশে এসে ব্যবসা করলেও এখান থেকে যাওয়া যেতনা। কারণ দেশটি ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। ব্রিটিশরা চাইতনা ভারত থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামীরা অবাধ চলাচলের মাধ্যমে ওখান থেকে কৌশল ও প্রেরণা লাভ করুক। কিন্তু রামনাথের স্বাধীনতার প্রেরণা ছিলো দুর্ণিবার। আফগানিস্তানের ব্যাপারে তার বিশেষ আকর্ষণের আরো কারণ ছিলো। তা হচ্ছে দেশটির মানুষের বিশেষত মুসলমানদের ব্যাপারে ভারতবর্ষে ভীষণ রকম নেতিবাচক প্রচারণা ছিলো। তিনি এসব ঘেঁটে দেখতে চেয়েছিলেন। আর এসব উদ্দেশ্যে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপীয় পোশাকে সাহসের সাথে আফগান পর্যটনে পা ফেলেন।
রামনাথ আশা নিরাশার দ্বন্দ্ব নিয়ে অনেক চেষ্টায় এবং ভাগ্যের সহায়তায় ভূ পর্যটক হিসেবে আফগানে প্রবেশের অনুমতি লাভ করেন।
আজকের মত প্রায় ১০০ বছর আগেও এই দেশের মানুষগুলোর ব্যাপারে বাইরের দুনিয়াতে নানা ভীতিকর ধারণা প্রচলিত ছিলো। আফগানরা তাদের পাথুরে পার্বত্য ভূমির মতই কর্কশ, দুর্বোধ্য, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বর্বর – এভাবেই সবাই জানত। মূলত এটা ছিলো একটা প্রভাবশালী প্রচার-প্রোপাগান্ডা যা আজও অব্যাহত আছে। বিপরীতে বিভিন্ন দেশ থেকে আফগানিস্তান ভ্রমণকারী অসংখ্য সাংবাদিক ও পর্যটক তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন এরূপ নমুনাও যথেষ্ট আছে। রামনাথ বিশ্বাস এই দ্বিতীয় দলের অনুসন্ধানী। তিনি আফগানদের কিছু ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোঁড়ামিকে স্বীকার করলেও সামগ্রিকভাবে তাদের উচ্চ গূণাবলীর প্রশংসাও করেছেন। তিনি সেকালে ভারতবর্ষে প্রচলিত এই ধারণার কোন ভিত্তি পাননি যে, ওখানে জোর করে মুসলমান বানানো হয় কিংবা ওখানে হিন্দুরা মুসলমানদের দ্বারা কোনঠাসা হয়ে সংকীর্ণভাবে জীবন কাটাচ্ছেন।
আমরা রোমাঞ্চকর ভ্রমণটি দেখব, তৎকালীন আফগানিস্তানের সাথে পরিচিত হব এবং চলমান সময়ের সাথে সেসময়ের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে নেব।
নিরাপদ মনোরম পর্যটন পরিবেশ
১৯২৮ সালের পর ৬ বছরে অর্থাৎ ১৯৩৪ সাল অবধি সময়ে রামনাথ ৬ষ্ঠ পর্যটক হিসেবে আফগানিস্তান ভ্রমণ করেন। বর্তমান পাকিস্তান এবং তখনকার ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের পেশওয়ার হয়ে পূর্ব আফগানিস্তানের জালালাবাদ প্রবেশের পর থেকে পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাত হয়ে ইরান প্রবেশ করা অবধি ২ মাসের বেশী সময়ের সফরে কোথাও কোন রকম নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ তাঁকে স্পর্শ করেনি।
পথের পাশে রাত কাটিয়েছেন, আবার সরকারী ডাক বাংলোতে থেকেছেন; আশ্রয় পেয়েছেন দোকানে, মসজিদে বা মন্দিরে;উষ্ণ আতিথেয়তা লাভ করেছেন অপরিচিত ও অজানা মুসলিম ও হিন্দু গৃহে;মাটির তৈরী পর্ণকুটিরে বিশ্রাম নিয়েছেন, আবার আয়েশ করেছেন কোটিপতির বাড়িতে। মজার ব্যাপার, কয়েক বারই এমন হয়েছে যে, স্বধর্মের আফগান মেজবান তাঁকে অতিথি হিসেবে বরণ করতে ইতস্তত করেছেন কিংবা অনিচ্ছা নিয়ে তাঁকে থাকতে দিয়েছেন। এমনকি মন্দিরেও এমন হয়েছে। কিন্তু কোন মুসলিম আফগানের কাছ থেকে তিনি এরকম বিরক্তিকর আচরণের সম্মুখীন হননি।
রামনাথের ভাষায়, “আফগানিস্তানে এসে দেখেছি এসব মিথ্যা ও গাঁজাখুরি গল্প। কোথায় ডাকাতের অত্যাচার আর কোথায় হিন্দুবিদ্বেষ? কেউতো এখনো এলোনা আমাকে কলমা পড়িয়ে মুসলমান বানাতে!” [২৫ পৃষ্ঠা]
আরো বলেছেন, “আফগান জাতিকে যারা নিষ্ঠুর, নরঘাতি বলে চিত্রিত করেছে, তাদের প্রতি ঘৃণা হয়েছিলো। খাওয়ার পর কুমিদানকে [গ্রামের দারোগা] আফগানিস্তান সম্পর্কে সেই সব মিথ্যা রটনাগুলোর কথা বলেছিলাম। শুনে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, এ তো সামান্য কথা। পৃথিবীতে কত হীন মিথ্যাবাদী আছে, যারা তিলকে তাল করে লোকসমাজে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার করে।
পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আফগানিস্তানের পাঠানদের বিরুদ্ধে প্রচারণা সনাতনী হিন্দুরাই বেশী করেছে। উদারতার গুণে কোনো কোনো হিন্দু উন্নতির পথে অগ্রসর হচ্ছে, পক্ষান্তরে ঐ গুণটির অভাবে অনেকে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে।“ [২৫ পৃষ্ঠা]
একবার এক মসজিদে রাত কাটানোর সময় পূর্বদিকে মাথা রেখে এবং পশ্চিম দিকে পা দিয়ে শোয়ার পরেও তাঁকে কিছু বলা হয়নি। মুয়াজজিন তাঁকে ভোর রাতে জাগিয়ে বলেন, আপনি হয়ত আজানের শব্দে ভয় পেতে পারেন, তাই ডেকে দিলাম। বিদায়ের সময় মুয়াজজিন মোল্লা বলেছিলেন, “আপনার অনেক অসুবিধা হয়েছে নিশ্চয়ই, সেজন্য ক্ষমা করবেন। দুঃখের বিষয়, আমাদের গ্রামে মুসাফিরখানা নেই।“ [৩৩ পৃষ্ঠা]
জালালাবাদ হয়ে কাবুল অবধি সফরটা বেশ মজারই ছিলো। কাবুলে যেতেই ভীষণ শীত ও তুষারপাত শুরু হয়, একইসাথে রামনাথ কিছু প্রশাসনিক জটিলতায় পড়েন। আগে চীন ভ্রমণের সময়ে সেখানে কর্মরত তৎকালীন আফগান প্রধানমন্ত্রীর আত্নীয়ের কাছ থেকে একটা পরিচয়পত্র পেয়েছিলেন। এর সাহায্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী সরদার মোহাম্মাদ হাশিম খানের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে যান, বিশেষ প্রোটোকল লাভ করেন এবং ইরান প্রবেশ পর্যন্ত বিশেষ সুবিধা পান।তাঁকে একটা মোটর গাড়িও দেয়া হয় কাবুল থেকে গজনি পৌঁছতে, গাড়ীটির নাম “মোটরে পোস্ত”। তবে এর মধ্যেই ব্রিটিশকনসাল কর্তৃক একটা আপত্তিকর আচরণে ক্ষতিগ্রস্থ হন। এ ব্যাপারে পরে বলছি।
কাবুলের রাস্তায় এক রাতে মাইনাস ১৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হন। নিকটের এক চায়ের দোকানের লোকেরা টের পেয়ে তাঁকে উদ্ধার করে। আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কারণে কাবুলে এবং পরে কান্দাহারে এক মাস করে অবস্থান করতে হয়। এই ফাঁকে বিশেষ কিছু অনুসন্ধান লাভ সম্ভব হয়।
গজনি গিয়ে লেখক জানতে পারেন, রাজা আমানউল্লাহ যিনি ১৯১৯ সালে আফগানিস্তানকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করেন, তিনি সড়কগুলোতে ১২ মাইল অন্তর অন্তর সরাইখানা তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এটা বাস্তবায়নের আগেই ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দেশত্যাগ করেন। অন্যেরা তা আর করলনা। আমানউল্লাহর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আফগান ভ্রমণ আরো সহজ হতো। বৃহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে সুবিধা ও অসুবিধা যুগপৎভাবে আসবে। মুসাফির সেটা জেনেই পা বাড়ায় এবং সুখ-দুঃখকে সঙ্গী করেই বিজয়ের মঞ্জিলে পৌঁছতে হয়।
শীতের আগে ও পরে পাথুরে পর্বতের ঢেউ ভীষণ মনোহর ও ক্লান্তিনাশক। বৃক্ষহীন ভূ তরঙ্গের কালো ছায়ার শোভা পর্যটকের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে। আবার শীতের বরফঢাকা পর্বত দিন ও রাত দুই সময়েভিন্ন প্রকৃতির রূপ বিলাতে থাকে। দিনের বেলায় সূর্যের আলো বরফে প্রতিফলিত হয়ে চোখ ঝলসে দিতে চায়। তখন রঙীন চশমার দরকার হয়।
একটি লোভনীয় দৃশ্য।দৃশ্যটি কান্দাহার থেকে হেরাতের পথের। উত্তরে ক্রমশ উঁচু আর দক্ষিণে ক্রমশ নীচু।
“উত্তর দিকে ঢেউ খেলানো সারি সারি পাহাড়। দক্ষিণ দিকে যতদূর দেখা যায় অনন্ত প্রসারিত প্রান্তর ক্রমনিম্নভাবে দিগন্তে মিশেছে। দুদিকের দৃশ্যাবলীই নয়নমুগ্ধকর।“ [১৮৭ পৃষ্ঠা]
শীতের রাতে খাবারের খোঁজে সাইবেরিয়া থেকে আসা নেকড়ের দল রাস্তায় রাস্তায় পাড়ায় পাড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্দুক, মেশিনগান দিয়েও প্রতিরোধ করা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। অনেক সময় দুর্বল দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে গৃহবাসীকে খেয়ে ফেলে। এজন্যে এই সময়ে রাতের আফগানিস্তান একেবারেই নিস্তব্ধ থাকে। সবাই যার যার আলয়ে নিজকে সুরক্ষিত রাখে। এমনি অবস্থাতেও কখনো কখনো মুসাফিরকে ঝুঁকি নিয়ে পথ চলতে হয়, যখন নাকি নিদৃষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়না। তখন বিপদ ভুলে অন্য নেশায় মগ্ন থাকতে হয়। এমনি এক রাতে। এই রাতে তার গজনী পৌঁছতে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিলো।
“আকাশে চন্দ্র উঠেছে। স্বচ্ছ, সুনীল আকাশে নক্ষত্ররাজি ঝকমক করছে। চতুর্দিকে পূর্ণচন্দ্রের শুভ্র আলো বরফে আবৃত পার্বত্যভূমির ওপর পড়ে এমন সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করেছিলো, যা দেখে মনে হচ্ছিল এমন অপরূপ জ্যোৎস্নারাত্রি এ জীবনে আর হয়ত দেখিনি। ভাবছিলাম আমি যদি কবি বা সাহিত্যিক হতাম, তা হলে হয়তো এই সৌন্দর্য ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে পারতাম।“ [১৫৬ পৃষ্ঠা]
কে বলেছে রামনাথ সাহিত্যিক নন? এইতো কত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুললেন! তবে “কবি” বা “সাহিত্যিক” তার আসল পরিচয় নয়, তার আসল পরিচয় তিনি একজন “বিপ্লবী পরিব্রাজক”।
আফগানিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি
আফগানিস্তান বহু ভাষাভাষীদের দেশ। গোত্র ও অঞ্চল্ভেদে ভাষার এই পার্থক্য। প্রধান ভাষা পোস্ত বা পশতু। পোস্ত হচ্ছে বিশুদ্ধ আফগানী উচ্চারণ, আর বাইরে পশতু নামেও পরিচিত। লেখক তার বইতে দুটি শব্দই দিয়েছেন। তবে আফগানরা বিদেশী ভাষাতেও পারদর্শী। কারণ এখানে চারপাশের দেশগুলোসহ ইতালি, জার্মান, ফ্রান্স ও জাপান থেকেও লোকদের যথেষ্ট আসা যাওয়া ছিলো। এই যাতায়াত ছিলো কুটনৈতিক ও ব্যবসায়িক কারণে। লেখকের সময়ে সেখানে ইরানি অর্থাৎ ফারসী ভাষায় কথা বলা ছিলো আভিজাত্যের লক্ষণ। এছাড়া আফগানরা বাংলা, হিন্দী, হিন্দুস্তানি, উর্দু, ইংরেজী, ফরাসী ও রুশ ভাষায় মত বিনিময়ে অভ্যস্ত ছিলো। ৩ মাসের ভ্রমণে লেখক হিন্দী, হিন্দুস্তানি, বাংলা ও ইংরেজীতে আফগানদের সাথে গল্প আলাপ সম্পন্ন করেছিলেন।
লেখক অকপটে স্বীকার করেছেন যে, আফগানদের রুচি ও সংস্কৃতি ভারতীয়দের চেয়ে উন্নত। কিছু উদ্ধৃতি।
“এখানকার গৃহনির্মাণ পদ্ধতি আমাদের দেশের মতো নয়। আমাদের দেশে ঘরগুলো ক্রমেই পথকে গলা টিপে মারতে চেষ্টা করে। আর ওদের ঘরগুলো ক্রমেই সরে পথকে প্রসারিত করে দিচ্ছে। আর্য সংস্কৃতির এটাই বিশেষত্ব।“ [৩১ পৃষ্ঠা]
“দুম্বা সাধারণত বাড়িতে কাটা হয়না। কোনো অতিথি থাকলে হত্যা কাজটি আরো গোপনে করা হয়, যাতে অতিথি মোটেই টের না পান। এটা হলো পাঠানদের প্রথা এবং তাদের সভ্যতার অংশ। আমাদের দেশে হিন্দুরা পাঁঠা বলি দেয় সকলকে দেখিয়ে, মুসলমানরা ছাগল কাটে উঠানের ঠিক মধ্যস্থলে। কিন্তু এ বিষয়ে আফগানিস্তানের প্রথা যে শ্রেষ্ঠ তাতে কোন সন্দেহ নেই।“ [৬৩ পৃষ্ঠা]
নারীদের পোশাকের ব্যাপারে তারা আজকের মত তখনও রক্ষণশীল ছিলো। মেয়েরা ঢিলাঢালা পোশাক পরে আবৃত হয়ে চলত। ভিন পুরুষের সাথে কোন নারীর চলাফেরা গ্রহণযোগ্য ছিলোনা। কাবুলে একবার এক হিন্দু বাঙালী মহিলা ও তার পরিবারের সাথে রামনাথের পরিচয় হয়। সে ঘরে তিনি কয়েক বেলা মেহমানও হন। একবার সেই মহিলার মুসলিম স্বামীর জ্ঞাতসারেই তিনি মহিলা ও তার সন্তানদের সাথে বাজারে যান। লোকজন বেশ তাকাচ্ছিলো তাদের দিকে। ব্যাপারটা দেখে মহিলা তার সন্তানদের বলে দেন যে, তোমরা বল ইনি আমাদের কলকাতার মামা।
মেয়েটির করুণ জীবন কাহিনী লেখককে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। সে দুর্ভাগ্যক্রমে ভারত থেকে কাবুলে এসে পড়েছিলো। সেজন্যে অবশ্য তার পাঠান মুসলিম স্বামী দায়ী নয়। দায়ী পূর্ববঙ্গের মেয়ের গ্রামের সমাজপতিরা। পরে অবশ্য সে আফগানিস্তানে মানিয়ে নিয়েছে। তবুও আবার দেশে গিয়ে থাকতে মন চায়।
রামনাথের আর্তচিৎকার, “সমাজের পাপে, সমাজপতিদের জঘণ্য মনোবৃত্তির দরুণ, বাঙলার কত লক্ষ্মী যে এরূপভাবে দিন কাটাচ্ছেন!” [১১৪ পৃষ্ঠা]
আফগানিস্তানে তখনও নাচ-গান ও নাটক-সিনেমার চল ছিলোনা। লেখকের ভাষায় কাবুলের প্রাণ হচ্ছে ডিপ্লোমেটিক চালবাজি ও রাজনীতি। কাবুল রাজনীতি বিদ্যা শেখার একটা দারুণ স্থান। উত্তরে সোভিয়েত রাশিয়া ও পশ্চিমে ইরান হয়ে তুর্কি পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোর প্রভাবে কাবুলে বেশ রাজনীতির চর্চা হয়। দক্ষিণের ভারত থেকে ব্রিটিশরা এজন্যেই কাউকে সেখানে যেতে দিতে চাইতনা; যাতে স্বাধীনতাকামীরা সুযোগ পেয়ে রাজনীতির গুটিবাজি করতে না যায়।
খাদ্য নিয়ে কিছু গল্প। রোমাঞ্চকর সফরের ধারা বর্ণনায় খাদ্যের সুবাস পাঠকের মনেও ভ্রমণের নেশা জাগায়। আফগানরা সব খাবারেই অভ্যস্ত। ভাত, পোলাও,রুটি, আলু, মাছ, ডিম, উট, দুম্বা – সবই পাওয়া যায়। অনেক সময় মেজবান জানতে চেয়েছেন, ভাত না রুটি খাবেন। ভুনা দুম্বা প্রায়ই ছিলো। পাঠানরা মাংসে ভারতীয়দের মত বেশী মসলা দেয়না। কাবুলের এক মন্দিরে ঘি-খিচুড়ির স্বাদ ভোলার নয়। কষ্ট-ক্লেশের পরেই খাবারের আসল স্বাদ পাওয়া যায়।
চায়ের দোকানের অন্ত নেই। লোকজন পেয়ালার পর পেয়ালা চা নেবে আর রাজনীতিরপর্যালোচনা করবে। একেবারে রামনাথের মতই।
“আফগানিস্তানে দুরকমের চায়ের প্রচলন আছে, ইংলিশ চা ও চায়। দার্জিলিং, সিংহল ও আসাম হতে আফগানিস্তানে যে চা যায় তাকে ইংলিশ চা বলা হয়। ইংলিশ চা-তে দুধ ও চিনির দরকার হয়। “চায়” আসে চীন দেশ থেকে। সেই পাতা গরম জলে ভিজিয়ে দিলেই ক্বাথ বের হয়। সেই ক্বাথকেই বলে “চায়”।“ [৮৭ পৃষ্ঠা]
লেখকের চায়ের আকর্ষণ বোঝা যায় একটা অপ্রত্যাশিত বিড়ম্বনার পরে প্রচন্ড কষ্টে চা না খাওয়ার কথায়। অর্থাৎ এতই বিপর্যস্তবোধ করেছিলেন যে, স্বভাবসুলভ চায়ের তৃষ্ণাও পায়নি। ঘটনাটি শুনি।
সিঙ্গাপুরের এক ব্যাংকে লেখকের ২১ পাউন্ড অর্থ জমা ছিলো। লেখক তা হাতে না নিয়ে কাবুলের ব্রিটিশ কনসালের কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেন আফগান সফরে গিয়ে তুলবেন বলে। কিন্তু ব্রিটিশ কনসাল ভীষণ অভদ্র ও রুক্ষভাবে জানিয়ে দেন, সেই অর্থ আবার ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী আচরণ বটে! কিন্তু পর্যটকের টাকার প্রয়োজন। লেখক প্রচন্ড কষ্টে ফিরে গেলেন। কাবুলে পরিচয় হওয়া লোকজন জিজ্ঞেস করছিলো, তিনি অসুস্থ কিনা। বিল্পবী পর্যটক চাও খেলেন না।
“নির্বাক হয়ে পথ চলছিলাম, ফেরবার পথে কোথাও চা খেলাম না। প্রচন্ড শীতেও অনুভূতি পর্যন্ত হচ্ছিল না। একদম শীত-গ্রীষ্মবোধহীন হয়ে শহরের দিকে, মাথানত করে পলাতক পশুর মতো, কোথাও আশ্রয় পাওয়ার জন্য এগিয়ে চলছিলাম।“ [১২১ পৃষ্ঠা]
সংস্কৃতির ব্যাপারে আরো বিভিন্ন আলাপ আমরা সামনে পাব।
আফগানিস্তানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা
লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী দেশটি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার একটা ভাল নমুনা। মুসলমানদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের ভেতরে ধর্মীয় গোঁড়ামি অর্থাৎ ধর্মের অপব্যাখ্যা ও বাড়াবাড়ির চর্চা থাকলেও সেটা নিজেদের সমাজে, নিজেদের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে চর্চিত হয়েছে। তারা অমুসলিমদের উৎপাত করাতো দূরের কথা, বরং খুশী রাখতে চেষ্টা করে। ভ্রমণের আগে শোনা আফগান মুসলমানদের প্রচন্ড হিন্দু বিদ্বেষের কোন নমুনা তিনি পাননি।
ভ্রমণের শুরুতে জালালাবাদে প্রবেশের সময়টা ছিলো রোজার মাস। এক দোকানে খাবার চাইলে বলা হল, রোজায় তিনি দিনে খাবার বিক্রি করেন না। রামনাথ বললেন, আমি হিন্দু। দোকানদার নিজ হাতে খাবার দিতে অস্বীকার করলেন, লেখককে নিয়ে নিতে বললেন। লেখক ভুলে গরুর মাংসের হাঁড়িতে হাত দিতে গেলে দোকানি চিৎকার করে ওঠে, এ মাংস তুমি খেতে পারবেনা। পাশের হাঁড়ি থেকে নাও। [২১, ২২ পৃষ্ঠা]
“পরদিন অল্প সময়ই গ্রামে ছিলাম। এই সময়টুকুতেই বুঝতে পেরেছিলাম, গ্রামের “ধ্বংসোম্মুখ হিন্দু”দের খুশী করার জন্য গ্রামের ভেতর কোনো মুসলমান গো-হত্যা করেনা। গো-হত্যা হয় গ্রামের বাইরে, বহুদূরে। কাটা মাংস গ্রামে গোপনে আসে এবং গোপনেই বিক্রি হয়ে থাকে। আফগানরা এমনিভাবেই হিন্দুদের খুশী করে থাকে।“ [২৫ পৃষ্ঠা]
আফগান রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও মুসলিম ও হিন্দু সবার অংশগ্রহণের বিধান রাখা হয়েছিলো। লোকসংখ্যা অনুযায়ী প্রত্যেক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকেই প্রতি বছর দেশরক্ষায় সেপাই সরবরাহ করতে হতো। গোষ্ঠীতে কয়জন হিন্দু বা মুসলিম সেটা বিবেচ্য বিষয় ছিলোনা। তবে ব্যাপার হচ্ছে, হিন্দুরা সাধারণত সেপাই সরবরাহ করতোনা। তারা নিজেদের গোষ্ঠী থেকে মুসলমানদের ভাড়া করে পাঠাত এবং সরকারী মাইনের বাইরে নিজেরা অতিরিক্ত মাইনে দিত। [২৩, ২৪ পৃষ্ঠা]
ইরানে প্রবেশের আগে লেখক হেরাতে একজন কোটিপতি হিন্দুর বাড়িতে মেহমান হয়েছিলেন। লোকটি আফগান ব্যাংকের অর্ধেক শেয়ারের মালিক ছিলো। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা না থাকলে একজন হিন্দুর পক্ষে একটা রক্ষণশীল মুসলিম দেশে এরূপ একটা অবস্থান প্রাপ্তি নিশ্চয়ই সম্ভব ছিলোনা।
আফগান সমাজে মানবীয় মর্যাদা
আফগানিস্তানে ধনী-গরীব, ছোট-বড়, উঁচু-নীচু নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের সমান মর্যাদা দেখে লেখক খুব ভালো বোধ করেছেন। ইতিহাস কাঁপানো কাবুলের ছিমছাম সাজ-পরিবেশ নিয়ে রামনাথের অনুভূতি।
“শহর মামুলি ধরনের গড়া। যেকোনো পাঞ্জাবি শহর কাবুলের চেয়ে বড়ো। ঘরগুলোও পাঞ্জাবি ধরনে তৈরী। বিশেষত্ব কিছুই অনুভব করলাম না, অন্তত বাড়ি-ঘরের দিক থেকে। কোথাও নৃত্যগীত অথবা সিনেমা হাউজ ছিল না। কিন্তু চায়ের দোকান সর্বত্র। চায়ের দোকানে আবার জাতি-বিচার নেই। সবাই প্রবেশ করতে পারে এমনকি মেথর পর্যন্ত।“ [৮১ পৃষ্ঠা]
স্বাধীনচেতা আফগান মানস ও মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা
এটাই আফগানীদের মূল বৈশিষ্ট্য। উচ্চ শির জাগানিয়া আত্মা ধারণকারী জাতিগুলোর মধ্যে আফগান জাতি একটি। আফগানদের মধ্যে আনুগত্যপরায়নতা কম। এই গুণ জাতি হিসেবে তাদেরকে মুক্ত স্বাধীন রেখেছে। আবার তীব্র আত্মমর্যাদাবোধের সাথে আনুগত্যবোধের সমন্বয়ের অভাবেই তারা সবাই মিলে একটা সুসংহত রাষ্ট্র-সমাজ গড়তে ব্যার্থ হয়েছে।
“এদের রাজভক্তি ও প্রজাসুলভ বশ্যতার ভাব নেই। এরা নিজেরাই যেন এক-একজন রাজা।“ [৪৪ পৃষ্ঠা]
আফগানিস্তানের নানা গোত্রের ও গোষ্ঠীর নিজস্ব কিছু ধ্যান ধারণা ও বিধি ব্যবস্থা থাকে। এসব ব্যাপারে তারা রাজকীয় ফরমান বা প্রতিবেশী প্রভাবশালী গোষ্ঠীর তোয়াক্কা করেনা।
“রাজার পেয়াদা অথবা চাকর গ্রামের মালিকের কাছে হাজির হয়ে রাজকীয় আদেশ জানিয়ে আসে। গ্রামের মালিক সবাইকে ডেকে রাজার আদেশ শুনিয়ে দেয়। সর্বসাধারণ যদি সে আদেশ ভালো মনে করে, তবে মেনে নেয় নতুবা অগ্রাহ্য করে। রাজার আদেশ সকল সময় চলেনা। গ্রামের লোক স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সমেত কবরস্থ হতে রাজি, তবুও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে রাজী নয়। সেজন্যই আফগান জাতি নানাদিকে বাঙালির পেছনে থেকেও বাঙালির চেয়ে কমপক্ষে একদিকে উন্নত-জীবন কাটাচ্ছে।“ [১২৩ পৃষ্ঠা]
“এখানে একটা মজার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, যদি কোনো গ্রামে পাঁচ ঘর হিন্দু, দশ ঘর শিয়া ও পচিশ ঘর সুন্নি থাকে, তবুও দুটি সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণীর লোক সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা শুনবে না।“ [ঐ]
“যেখানে লোকের চলতি পথে স্বাধীনতা আছে, সেখানে লোকে রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র; এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। পাঠানরা স্বাধীন, তাদের মাথা ঘামাতে হয় না; দূররানী বংশ রাজা হলো নাকি খিলজাই বংশের লোক রাজা হলো। তারা কখনো ভাবে না, কে সরকারি চাকুরি পেল আর কে পেল না। তাদের আত্মরক্ষা করার জন্য তলোয়ার, বন্দুক, পিস্তল, অটোমেটিক মেশিনগানও আছে। সেজন্যই সে কাউকে ভয় করে না। নিজের পরিবার, গ্রাম এমনকি ছোট ছোট সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী পর্যন্ত নিজেরাই নিজেদের দেখাশোনা করে থাকে।“ [ঐ]
“পাঠান চাষা অন্যায়কে কখনো প্রশ্রয় দেয় না। নায়েববাবু, পেয়াদাবাবু, কেরানিবাবু, পুলিশবাবু; এসবের ধার ধারেনা, অন্যায় করেছ তো মরেছ। অটোমেটিক মেশিনগান চালিয়ে প্রতিকার করবে ঐ দরিদ্র চাষা।“ [ঐ]
কারো কারো ভুল ধারণা হতে পারে যে, আফগান রাজশক্তি সেখানের ব্যাক্তি ও গোত্র পর্যায়ের এই তীব্র আত্মমর্যাদাবোধকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করে কিনা। লেখকের সহজ কথা হচ্ছে “না”।
“”কিন্তু আফগানিস্তানের শাসন-নীতি ভেদনীতি [divide and rule] এর পক্ষপাতী নয়, আফগান জাতিও ভেদনীতির সমর্থক নয়। আমার জমি আমি চাষ করছি। আমার বাড়িতে আমি বাস করছি। ঋণের দায় আমার কিছুই কমছে না, আমি ভেদবুদ্ধি প্রণোদিত হয়ে কার সাথে বিবাদে প্রবৃত্ত হব?” [ঐ]
আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক রীতিনীতি
আফগানিস্তানে তখন রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু ছিলো। রামনাথের ভ্রমণ বর্ণনাতে সংবিধান ও আইনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তবে রাষ্ট্র-সমাজে যে ইসলামের যথেষ্ট প্রভাব ছিলো সেটা নিশ্চিতভাবে বলা হয়েছে। যেমন- চোরের হাত কেটে ফেলা হতো, মদ্যপানের শাস্তি প্রদান করা হতো, পর্দা প্রথা ইত্যাদি। অমুসলিমদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার বলবৎ ছিলো।
ধর্মের সমালোচনার ব্যাপারে বলতে গিয়ে লেখক এ দেশকে দ্বিতীয় নেপাল বলে আখ্যা দেন। এখানে ধর্মের বিপক্ষে কিছু বলা যাবেনা। এমনকি ধর্মের নামে যদি কোনো গলদ প্রচলিত থাকে তাও নির্দেশ করার অধিকার নেই।
অনুমান করাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, আফগানিস্তানে আন্তঃগোত্রীয় ঈর্ষা ও হিংসা প্রকট ছিলো। আর সেজন্যেই ব্যাক্তি ও গোত্র পর্যায়ে নিরাপত্তার জন্য নিজস্বভাবে সব রকম অস্ত্রশস্ত্র রাখাটা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ছিলো। আমরা আগেই বলেছি যে, অত্যন্ত উচ্চমানের মানবিক বৃত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা সবাই মিলে একটা সুসংহত রাষ্ট্র গড়তে ব্যার্থ হয়েছেন।
এছাড়া আফগানরা পৃথিবীর নিত্য নতুন বিষয়াদির সাথে সমন্বয় করে এগিয়ে যেতে অনেক ক্ষেত্রেই অনাগ্রহী ছিলো। এর সাথে ধর্মীয় গোঁড়ামি যোগ হয়ে তাদেরকে পিছনে ফেলে রাখছিলো। আর এই অবস্থাটা এখনও অব্যাহত আছে।
ধর্মীয় গোঁড়ামির কুপ্রভাব
বইতে বেশ কয়েকবারই “ধর্মীয় গোঁড়ামি”, “মোল্লাতন্ত্র” ইত্যাদি পরিভাষা এসেছে। ব্যাক্তিভেদে শব্দগুলোর তাৎপর্য বিভিন্নভাবে গৃহীত হয়। এই পরিভাষাগুলো দ্বারা রামনাথ মূলত ধর্মের নামে অধর্ম ও অজ্ঞানতাকে বুঝিয়েছেন।আফগানদের ইসলামী আবেগে বাড়াবাড়ি যুক্ত হয়ে দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করছিলো। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ইয়াকুবের সাথে কাবুলে যাবার পথের একটা ঘটনা।
“একটু যাওয়ার পর পাশেই একটি কবর পড়ল। ইয়াকুব সাইকেল থেকে নেমে কবরে গিয়ে প্রার্থনা করে বলল, “কী প্রার্থনা করেছি জানেন”? “বলো কী বলেছ।“ বলেই তার মুখের দিকে তাকালাম। সে মাথা নত করে বলল, “শেষ বিচারের দিনে যেন ঈশ্বর এই পবিত্র “ইসলাম আত্মা”র সদগতি করেন।“ [৭০ পৃষ্ঠা]
বিপুল সংখ্যক আফগান তাদের জাতির মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় গোঁড়ামির পরিসমাপ্তি চাচ্ছিলেন। তারা ধর্মবিরোধী ছিলেন না, তারা ধর্মের প্রকৃত অনুসরণ চাচ্ছিলেন। ইয়াকুবের প্রার্থনায় সেই ভাবটাই ফুটে উঠেছিলো। আবার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন। তারা বোখারা সালতানাতের মত একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাচ্ছিলেন। বোখারার বিপ্লব নিয়ে একটু পরেই বলছি।
গজনি গিয়ে দেখতে পান হিন্দুরা পাথরের ঘরে বাস করে। তাদের ঘরের ছাদ ক্রমশ উঁচু হওয়ায় শীতের সময়ে বরফ গড়িয়ে পড়ে যায়। কিন্তু মুসলমানরা পাথরের ঘরে বাস করেনা, তাদের ঘরের মাথার উপরে থাকে চাল। এর পরিণামে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মুসলমান তুষারপাতের সময়ে মারা যায়। গজনি শহর এভাবে যে কতবার উজাড় হয়েছে তার হিসাব নেই।
মুসলমানেরা হিন্দুদের মত করে গৃহনির্মাণ করতে পারবেনা- এটা ছিলো কিছু মোল্লার বিধান। লেখকের ভাষায়, “এখানেও মোল্লাইজমের ব্যাভিচার ফুটে উঠেছিলো।“ [১৬০ পৃষ্ঠা]
লেখক মেজবান পাঠান মুসলিমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বরফপাত হওয়াটা ধরে নিলাম আল্লাহর মরজি, কিন্তু ঘর বানানো তো আপনাদের ওপরই নির্ভর করে। পাথরের ঘর তৈরী করেন না কেন?” পাঠান চুপ থাকলেন, মোল্লাদের কোন বদনাম করলেন না। [১৬১ পৃষ্ঠা]
বোখারা সালতানাতে সমাজ বিপ্লব ও সোভিয়েতে অন্তর্ভুক্তি
১৭৮৫ সালে আমিরাত-ই-বোখারা নামক একটা স্বাধীন ইসলামী সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান উজবেকিস্তানের বোখারা ছিল এর রাজধানী। উজবেকিস্তান ছাড়াও তৎকালীন তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান ও আফগানিস্তানের অংশও এর মধ্যে ছিলো। ইসলামের কিছু ভুল ব্যাখ্যাজনিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অপশাসন একদল মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে। তারা রাশিয়ার সাহায্যে সমাজ বিপ্লব ঘটায়। ১৯২০ সালে “বোখারা আমিরাত” সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সময়ে আফগানিস্তান ব্রিটিশ কলোনীর আওতায় ছিলো।
অন্যদিকে মোল্লারা গেল ইসলাম, গেল তুর্কি জাত, বলে চিৎকার করছিলো। ব্রিটিশ সাহায্যে তুর্কী আনোয়ার পাশা বোখারায় হামলা চালায়। কিন্তু সফল হয়নি। বোখারায় নব প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্র বহাল থাকে।
বইটিতে বোখারার এই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে [৪৫-৫৩] পৃষ্ঠায়।
বোখারার পর্বে “মাহমুদ ও আমিনা” নামক এক যুগলের গল্প বলা হয়েছে। অবশ্য লেখক এই যুগলের গল্পের সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত নন, তবুও গল্পের রূপটা সামগ্রিক চিত্রের সাথে মিলে যাওয়ায় একে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আফগানিস্তানে নারীর অবস্থান
আফগানিস্তানে “নারীর অবস্থান ও কর্মপরিধি” ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়ে আসছে। রামনাথ অবশ্য এ ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দিয়ে কিছু বলেননি। লেখকের ধারা বর্ণনায় অনুমিত হয় যে, ওখানে নারীদের ব্যাপারে বর্তমান মিডিয়ায় প্রচারিত কিছু সংবাদ তৎকালীন সময়ের সাথে মেলে;মানে সেসব বাড়াবাড়ি এখনও আছে। আবার কিছু সংবাদ মেলেনা, যেমন নারীদেরকে তারা মানুষ মনে করেনা বা অত্যাচার করে ইত্যাদি। তবে হ্যাঁ, অপপ্রচারের সুযোগটা তারাই করে দিয়েছে, তাদের কিছু গোঁড়ামির কারণে বিদেশীরা অতিরঞ্জিত করে এটা ওটা বলার সুযোগ পেয়েছে। লেখকের দেয়া কয়েকটি তথ্য।
“[আলিজানের] পরিবারে অনেকগুলো লোক আছে। তার অনেকগুলো ছেলে মেয়ে। মেয়ে হওয়াটা পাঠানদের পক্ষে সৌভাগ্য। তিনটি মেয়ের পিতার সম্মানের অবধি নেই।“ [৬২ পৃষ্ঠা]
“আফগান রাষ্ট্র স্ত্রী-জাতির কোনো স্বাধীন সত্ত্বা স্বীকার না করলেও আফগানরা মায়ের জাতের যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণে কখনোই শৈথিল্য দেখায় না। স্ত্রীলোকের অসম্মানকারীর প্রতি কড়া শাসনের ব্যবস্থা নিজেদের হাতেই রেখেছে, রাজকর্মচারীর ওপর ছেড়ে দেয়নি। ………………………, পাঠানরা স্ত্রীলোকের প্রতি অত্যাচারীকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না। হত্যা তিন রকমের হয়ে থাকে। গুলি করে মারা, পাহাড়ের ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া ও শরীরটার নীচের ভাগ মাটিতে পুঁতে ফেলে বাকি অর্ধেকটাতে ক্রমাগত ঢিল ছোঁড়া।“ [১২৪ পৃষ্ঠা]
এই তথ্যটি জানানোর পরেই রামনাথ একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা বলেন। আহমেদাবাদ শহরের এক হিন্দু রমনী স্বেচ্ছায় এক পাঠানকে বিয়ে করে কাবুলে আসেন। কিন্তু কাবুলের আবহাওয়া ও বোরখা পরার বাধ্যতা তার মোটেই ভাল লাগছিলোনা। সে কাবুল ত্যাগ করতে চাচ্ছিলো। কিন্তু পাঠান স্বামী নিজেও ভারতে যাবেনা আর স্ত্রীকেও যেতে দিবেনা। এক পর্যায়ে মহিলা রাস্তায় এসে লোকজনকে সব বলা শুরু করল। পথচারীরা তৎক্ষনাৎ প্রতিকার করতে গিয়ে দেখে বেটা ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। অতপর মেয়েটি প্রথমে স্থানীয় হিন্দু প্রতিনিধির বাড়িতে আশ্রয় নেয়, মাস তিনেক পরে তার আহমেদাবাদে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। [১২৪-১২৫ পৃষ্টা]
লেখক বোখারার পর্বে “মাহমুদ ও আমিনার” গল্প বলতে গিয়ে লিখেছেন, “কুরআন পর্যন্তই মেয়েদের পড়বার অধিকার ছিলো।“
“কোরআন শেখা পর্যন্তই মেয়েদের শিক্ষার অধিকার”- এরূপ ধারণা আসলেই ইসলাম দেয়নি। আজকের আফগানিস্তানে নারীর অবস্থান সেসময়ের চেয়ে উন্নত হলেও অনেক ক্ষেত্রে আগের প্রভাবটা বলবৎ আছে। বর্তমান আফগান সরকার শুরু থেকেই নিজেদের কাঠামোতে সমাজ-রাষ্ট্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলে আসছে। তবে এখনও কাঠামোটা পরিষ্কার করে উপস্থাপন করতে পারেনি। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের মডেল দেখতে আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।
আফগানিস্তানে নারীদের চলার পরিধির এই ব্যাপারটা বিশেষত শিক্ষা বিষয়ে তাদের সীমিত সুযোগের কারণ বোধগম্য নয়। আল্লাহর রাসূলের [সঃ] সময়ে উম্মুল মুমিনীন এবং অন্যান্য মহিলাবৃন্দ শিক্ষা-সংস্কৃতিতে কী ভূমিকা রেখেছিলেন সেটা সবারই জানা বিষয়। আফগানিস্তানও কোন সভ্যতাবর্জিত জনপদ নয়। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আবু দাউদসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ত্ব এই ভূমিতে জন্ম নিয়েছেন। এখানকার আশেপাশের এলাকাতেও জন্ম নিয়েছেন ইমাম বুখারীসহ অনেক কালজয়ী ব্যাক্তিত্ত্ব। এরূপ একটা পূণ্যভূমিতে নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ বাধাগ্রস্থ হওয়াটা আসলেই বেমানান লাগে।
আফগানিস্তানে হিন্দুদের অবস্থা
রামনাথ বিশ্বাস অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠতা ও সাহসিকতার সাথে তার নিজের ধর্মের লোকদের বহুবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি, দীনতা ও হীনমন্যতা, কুসংস্কার ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করেছেন। আফগানিস্তানে হিন্দুদের ধ্বংসোম্মুখ অবস্থার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। রামনাথ কয়েকবার নিজেকে স্বজাতির ভাইদের ঘরে ও মন্দিরে অনাহুত দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছিলেন, যেটা মুসলমান মেজবানদের আবাসে হয়নি। বইটিতে দুটি পর্বই আছে আফগান হিন্দুদের নিয়ে। “জালালাবাদে ম্রিয়মান হিন্দু সম্প্রদায়” ও “কাবুলে কুসংস্কারাচ্ছন হিন্দু সম্প্রদায়”। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় কথা আছে। রামনাথের মতে অনুসন্ধানের চিত্রকে হুবহু উপস্থাপন করাই পরিব্রাজকের কাজ। আর এতেই মানবজাতির উপকার হয়। সমস্যা সমাধানের পথ বের হয়। লেখকের কিছু ভাষ্য।
“এখানকার হিন্দুরা চার ভাগে বিভক্ত; সনাতনী, আর্যসমাজী, নানকপন্থী ও শিখ। শিখ ও নানকপন্থীদের মধ্যে পার্থক্য শুধু আচার-ব্যবহারেই, ধর্মের দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। নানকপন্থীরা দাড়ি-গোঁফ, হাতে লোহার বালা এবং নেংটি ও কৃপাণ [শিখদের ব্যবহৃত বিশেষ ছোরা] ব্যবহার করে না। শিখরা ধূমপান করেনা, কিন্তু নানকপন্থীরা সেটি করে।
আফগানিস্তানে আর্যসমাজীরা অপ্রকাশ্যেইথাকতে ভালোবাসেন। সেজন্য তাদের প্রকাশ্যে কোন শ্রেণি নেই, তারা সনাতনীদেরই অন্তর্ভুক্ত। ভেতরে ভেতরে কিন্তু সনাতনী ও আর্যসমাজীদের মধ্যে এত বিবাদ যে, আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেও তত বিবাদ নেই। এই বিবাদের একমাত্র কারণ, আর্যসমাজীরা জাতিভেদ মানেনা এবং বিধবা-বিবাহ করে। বিধবা-বিবাহ এমনিভাবে প্রচলিত, তিন-চার সন্তানের জননীরও এরা পুনরায় বিবাহ দেয় এবং অতি বৃদ্ধ বিধবা ছাড়া অন্য বিধবার মুখদর্শনই পাপ বলে গণ্য হয়। এতে আর্যসমাজীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে, আর সনাতনীরা সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হচ্ছে।“ [৪১ পৃষ্ঠা]
একবার হলো কি? কাবুলে এক সভায় লেখককে টাকা উপহার দেয়ার সময় লোকেরা টাকার তোড়াটি নিজেদের শরীরে বুলিয়ে নিচ্ছিল। লেখক এর মানে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, দেশ ভ্রমণকারীকে অর্থ সাহায্য দিলে দাতার শরীর থেকে রোগ চলে যায়। পর্যটক যত দূরে যাবে, বালাই তত দূরে চলে যাবে। আর এজন্যেই তারা শরীরে টাকা ছুঁয়ে দিয়ে অসুখ বিসুখ তাড়াচ্ছেন। [১৩০ পৃষ্ঠা]
কাবুলে রামনাথ হিন্দুদের মুখে এভাবে শুনে অবাক হয়েছেন যে, বাঙালি নাকি মন্ত্রবলে মানুষকে ছাগলে এবং ছাগলকে মানুষে পরিণত করতে পারে। বস্ত্র-ব্যবসায়ী হিন্দু পাঠানরা নাকি এরূপ তাজ্জব ব্যাপার বাঙলা মুলুকে স্বচক্ষে দেখেছিলো। কয়েকজন নেতৃস্থানীয় হিন্দু লেখককে মন্ত্র দিয়ে শারীরিক সুস্থতা ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করলে তিনি জানান, তিনি এসব বিশ্বাস করেন না বা জানেন না। তখন তারা লেখককে উক্ত অবাক করা তথ্যটি জানান। [১৩৩ পৃষ্ঠা]
এক রাতে গজনির পথে এক সরাইখানায় লেখক ও তার জাতিকে নিয়ে মজার গল্প হচ্ছিলো।
“একজন বলছিলো, বাঙালিরা পৃথিবীর মধ্যে এক নম্বর যাদুকরের জাত। ইচ্ছা করলেই যাকে তাকে ছাগল বানিয়ে রাখতে পারে। আরেকজন বলছিল, বাঙালিরা ছায়ামূর্তি ধারণ করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যায়, এজন্যই বাঙলা দেশে পথঘাটের কোনো বালাই নাই।
আমি বাঙালি একথা তারা জেনেছিল। সেজন্যই এসব গল্পের অবতারণা হচ্ছিল। একসময় তারা আমারই কথা তুলল। একজন বলল, “এই মুসাফিরের কোনো ভয় নেই। যখনই কোনো বিপদ আসে, তখনই সে বিপদ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। বাঙালি পৃথিবী ভ্রমণ করবে না তো করবে কে?
এরূপ নানাবিধ আলোচনার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।“ [১৫৩ পৃষ্ঠা]
লেখক আফগান হিন্দুদেরকে কুসংস্কার ও অবাস্তব তন্ত্রমন্ত্র বাদ দিয়ে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উন্নতির রাস্তায় চলার পরামর্শ দিতেন। কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে “দিন কেটে যাচ্ছে কোনো মতে”- এভাবে জবাব না দিয়ে সত্যিকার পাঠানের মত বলতে শিখিয়েছেন, ভাল আছি, দেহে শক্তি আছে, মন খুশী আছে।
লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী তখন আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ছিলো। এখন অবশ্য খুবই কম। বইটির সম্পাদক প্রাসঙ্গিকভাবেই বর্তমানে ওখানে হিন্দুদের সংখ্যা উল্লেখ করেছেন।
“[বর্তমানে আফগানিস্তানে মাত্র ৫০ জন হিন্দু আছেন, যারা মূলত মন্দিরের পুরোহিত। - Goyal, Divya, 28 July 2020, The Indian Express.] [১৮১ পৃষ্ঠা]
তরুণদের মাঝে দৃশ্যমান পরিবর্তনের প্রেরণা
পশ্চাৎপদতার মধ্যেও একদল উদ্যোগী তরুণ নতুন শপথে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলো। এদের সাথেও লেখকের পরিচয় হয়েছিলো। ইয়াকুবের সাথে কাবুল যাবার পথে এক সকালে লেখক বার বার পাহাড়ের দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন।
ইয়াকুবের জিজ্ঞাসা, “পাহাড়টার গায়ে আপনি কী দেখছেন?”
“প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছি হে।“
ইয়াকুব প্রাকৃতিক দৃশ্য পছন্দ করত না। সে বলল, “এই পাহাড়ে অনেক ধাতব পদার্থ আছে। যদি জিয়লজিস্ট এখানে অনুসন্ধান করেন, তবে হয়তো স্বর্ণ খনিও পেতে পারেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো আমাদের দেশে সে বন্দোবস্ত হয়নি।“ [৭৪ পৃষ্ঠা]
ইয়াকুবের সাথে লেখকের কাবুলের কাছে দেখা হয় এবং আফগান ভ্রমণের শেষ অবধি বিভিন্ন সময়ে সে লেখকের সঙ্গী হয়। ইয়াকুব ছিলো পরিবর্তনকামী। সে অনেক ঝুঁকি নিয়ে তার মিশনে কাজ করে যাচ্ছিলো।
জালালাবাদেও রামনাথের সাথে একদল ছাত্রের আলোচনা হয়। তারাও দেশ গড়ার উচ্চ মিশন ধারণ করত।
“সুখের বিষয়, ছাত্ররা কখনো জিজ্ঞাসা করেনি, কয়টা বাঘ একসাথে আমাকে আক্রমণ করেছিল বা ডাকাতের দল ওঁৎ পেতে বসে ছিল কি না? তারা জিজ্ঞাসা করেছিল চীন দেশের ছাত্রদের কথা; জাপানিরা সত্যিই নিজের, দেশের ও রাজার সম্মান বাঁচাবার জন্য হারিকিরি করে? নতুন ধরণের নতুন প্রশ্ন।“ [৪২ পৃষ্ঠা]
লেখকের আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, এদের নেতৃত্বেই একদিন আফগানিস্তানে কাঙ্খিত পরিবর্তন সাধিত হবে।
রামনাথ বিশ্বাসের নিজের আদর্শ
লেখক নিজে কোন আদর্শে বিশ্বাস করতেন সেটা সুস্পষ্টভাবে এই বইতে উচ্চারণ করেন নি। তবে সমাজতন্ত্রের প্রতি তার আকর্ষণটা বোঝা যায়। আবার এটাও ঠিক যে, তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। খুব সম্ভবত তিনি এমন একটা সমাজতান্ত্রিক ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা আন্তরিকভাবে তাদের আদর্শ পালন ও প্রচারে বাধা অনুভব করবেনা।
রামনাথ বিশ্বাসের চোখে আফগানিস্তানেরভবিষ্যতএবংআমরা যা দেখলাম
এই সফরে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে রামনাথ কয়েকটি ছোট্ট অনুচ্ছেদে যেভাবে প্রকাশ করেছিলেন, নতুন করে প্রকাশিত বইতে সম্পাদক সেই ভাষাকে বই এর অতিরিক্ত কভারের পিছনে স্থান দিয়ে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছেন।
“আফগানিস্তান ভ্রমণ করার সময় যা দেখেছি ও শুনেছি, তাই লিখেছি। ১৯১৯ সালের মে মাসে আফগানিস্তান স্বাধীন হয়ে একটি বাফার স্টেটে পরিণত হয়। যদিও আফগানিস্তান স্বাধীনতা লাভ করেছিল কিন্তু নানা কারণে সাধারণ লোকের আর্থিক কোনো উন্নতি হয়নি। আফগানিস্তানের বাসিন্দা সম্বন্ধে আমাদের মনে অনেক উদ্ভট ধারণা রয়েছে। আমাদের ধারণা, আফগানিস্তান যেমন কর্কশ ও পর্বতসংকুল, তেমনি আফগানরাও বুঝি দয়ামায়াহীন, অর্থলোভী ও হিংস্র। বস্তুত তা নয়। আফগানিস্তান সম্বন্ধে এই প্রকার বিকৃত ধারণা পোষণ করার কোনো হেতু আমি পাইনি।
আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ দিব্য চক্ষে দেখতে পাচ্ছি; এই দেশের তিন দিকে যে সকল দেশ আছে, এক রাশিয়া ছাড়া প্রত্যেকটি দেশের রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেই পরিবর্তনের সময় আফগানিস্তানও আপনা হতেই রূপ বদলাতে বাধ্য হবে। আফগানিস্তানের লোকসংখ্যা খুবই কম ও দেশটা পর্বতমালায় সমাকীর্ণ। নতুন পরিবর্তনের সময় এ দেশের লোকক্ষয় কমই হবে। সেজন্য আফগান জাতিকে কারো কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেও চলবে। যদি তাদের কারো কাছে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করতে হয়, তবে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে দেশের পর্বতমালার কাছে। পর্বতমালা হবে তাদের আশ্রয়স্থল।
আমার ভ্রমণ কাহিনী পড়ে আফগানিস্তানের যথার্থ স্বরূপ বুঝতে যদি সহায়তা হয় তবেই আমি নিজেকে কৃতার্থ মনে করব, আমার আফগানিস্তান ভ্রমণ সফল হবে।“
রামনাথের ভবিষ্যতবাণীর কিছু মিলেছে, আবার কিছু মিলেনি। প্রধান উল্লেখ্য ফল হচ্ছে আফগান জাতির প্রতিরোধ ক্ষমতার বিষয়টি। আফগানিস্তান একটা অজেয় ভূমি। তাদের একটানা লড়াই করতে থাকার বিস্ময়কর ক্ষমতা আমরা দেখেছি। গত চার দশকে তারা দু দুটি পরাশক্তিকে লড়াই করে বিদায় করেছে। আধুনিক যুগের আগেও আলেকজান্ডার, তাতার ও তৈমুরসহ বড় বড় শক্তি এখানে এসে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফেরত গেছে।
আফগানিস্তানের অপরাজিত থাকার মূল রহস্য এর দুর্গম ও দুর্বোধ্য পার্বত্য পরিবেশে নিহিত। এর কোলে লালিত দুর্গ প্রাচীরের মত সন্তানরাই এর রহস্য জানে। তাই দুই হাজার বছরের ইতিহাসে এদেরকে কেউ লম্বা সময় দখলে রাখতে পারেনি। অতএব রামনাথের উক্তিটি খুবই তাৎপর্যপুর্ণ, যদি তাদের কারো কাছে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করতে হয়, তবে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে দেশের পর্বতমালার কাছে। পর্বতমালা হবে তাদের আশ্রয়স্থল।
আবার লেখকের ধারণা ছিল শুধুমাত্ররাশিয়া ছাড়া আফগানিস্তান এবং সংলগ্ন অন্যদেশগুলোর রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তন নিশ্চিত। কিন্তু ৯০ এর দশকের গোড়ায় সোভিয়েত রাশিয়া পরিবর্তিত হয়ে গেলেও আফগানিস্তানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধেরখুব বেশী পরিবর্তন হয়নি। আফগানিস্তানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের চলাচল ছিলো, আফগানরাও অতিথিপরায়ন, মিশুক ও বহু ভাষায় দক্ষ। কিন্তু নানা সংস্কৃতির লোকদের সাথে মিশেও তাঁরা নিজেদের রক্ষণশীলতা অক্ষুণ্ন রেখেছে।
লেখক আশা করেছিলেন, নতুন পরিবর্তন তথা অগ্রগতির সময় সেখানে লোকক্ষয় খুবই কম হবে। আমরা এই ধারণার উল্টোটা দেখেছি। আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়নি। এমনকি তারা দুই পরাশক্তির সাথে বিজয়ী হলেও নিজেরা সুসংহত হয়ে একটা রাষ্ট্র কাঠামো গঠন করতে পারেনি। সোভিয়েতের দখলমুক্ত হবার পরে প্রায় এক দশক সেখানে কোন কার্যকর সরকার ছিলোনা। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশরক্ষা করার পরেই আত্মকলহে নিজেদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে। এ মুহুর্তে আমেরিকার দখলমুক্ত হলেও এখনও এটা নিশ্চিত না যে, আফগান জাতি একটা আদর্শ সমাজ-রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে সক্ষম হবে কিনা।
শেষ কথা
“আফগানিস্তান ভ্রমণ” একই সাথে ভ্রমণ বৃত্তান্ত এবং রাজনীতির বই।আফগান জাতি থেকে বাইরের পৃথিবীর শেখার আছে, বিশেষ করে ধৈর্য্য-সহিষ্ণুতা, নৈতিকতা, স্বাধীন চেতনাবোধ ও প্রতিরোধ ক্ষমতা। আবার বাইরের পৃথিবী থেকেও তাদের শেখার আছে। আফগান জাতি কিছু গোঁড়ামি ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে একটা সুসংহত ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে। তবে তারা কোন প্রকার চাপিয়ে দেয়া রীতিনীতিকে মেনে নেবেনা। তাদেরকে নতুন দুনিয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে রাজী করাতে হবে বুঝিয়ে শুনিয়ে; অবশ্যই হুমকি দিয়ে কিংবা অবরোধ করে নয়।
শতাব্দী আগের দুর্গম পরিবেশে একাকী বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া এবং সেটা সম্পন্ন করতে পারাটা আজকের মানসে প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার। ইতিহাসের গুটিকতেক ব্যাক্তির মধ্যে রামনাথ স্থান করে নিয়েছেন। আমরা আমাদের ছেলের জন্য গর্বিত। আমাদের প্রকাশকবৃন্দ তার ভ্রমণ ইতিহাসের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো নতুন জেনারেশনের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নেবেন – এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
© 2023 | All Right Reserved | Developed By WebGet