১. গাজায় নির্বিচারে বোমা হামলা
সম্প্রতি ফিলিস্তিনে ইসরায়েল যে বোমা হামলা চালাচ্ছে তা ইতিহাসে অন্যতম পাশবিক ঘটনা। একুশ শতকে উত্তর আধুনিকতাবাদের যুগে এসে আমাদেরকে আমেরিকার মদদে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচারে বোমা বর্ষণ দেখতে হচ্ছে। নিরীহ নারী ও শিশুদের ওপর এমন বর্বর হামলা আমাদের বিস্মিত করলেও অনেক দেশ এটার প্রশংসা করছে। গত ৩২ দিন ধরে ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে ইসরায়েল বোমা ফেলে শিশুসহ ১০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। ১ লাখের বেশি মানুষ আহতসহ কয়েক লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গোটা বিশ্ব বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো এটা নির্বিকারে অবলোকন করছে। আন্তর্জাতিক আইনে যেখানে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ইসরায়েলের মানবতা বিরোধী অপরাধে শাস্তি হওয়ার কথা সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব তাদের ইহুদি ইসরায়েলকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। যাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালানো হচ্ছে তাদেরকে বলা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসী’ আর যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে তাদের বলা হচ্ছে ‘আত্মরক্ষাকারী’। বেলফোর ঘোষণার আলোকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালের মে মাসে যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয় তা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
২. মধ্যে প্রাচ্যের কথিত মুসলিম দেশ
মুসলিম বিশ্বের যে ৫৭ টি দেশ রয়েছে তার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা হয় মধ্যপ্রাচ্যকে। নানা কারণে মুসলিম রাষ্ট্রসহ সব রাষ্ট্রের কাছেই মধ্যে প্রাচ্যের আলাদা একটা তাৎপর্য রয়েছে। মধ্যেপ্রাচ্যের দেশগুলোর খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল পেট্রোলসহ নানা প্রকার জ্বালানি সম্পদ সারা বিশ্বের মোড়লদের মোড়লীপনা হাত ছাড়া করে দিতে পারে সেটা তারা শতবছর আগেই বুঝতে পেরেছে। যে জন্য এই অঞ্চলের ঐক্য বিনষ্ট ও শক্তিকে খন্ডিত করার সূদুর প্রসারী লক্ষ্যের অংশ হিসেবে আজকের ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম। মুসলিম তাত্ত্বিকদের প্রাথমিক অনুধাবনে এটা না আসার দরুণ আজকে এই পরিস্থিতি। ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতিদানকারী প্রথম মুসলিম দেশ তুরস্ক, আর প্রথম আরব দেশ মিশর। কিন্তু বাস্তবতা হলো উপলব্ধি হওয়ার পরেও কি সেই বিভাজনের রাজনীতি থেকেই আমরা বের হয়ে আসতে পারছি? উত্তর হলো ‘না’। আর পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা ও তার মিত্ররা এক্ষেত্রে শতভাগ সফল। মুসলিম বিশ্বের হুঙ্কার শুধু দায়সারা বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ। আমরা চাইলেই কি পুনরায় সেই ১৯৭৩ সালের তেল অস্ত্রের আঘাতের সংকেত পশ্চিমাদের কর্ণকুহরে কম্পন সৃষ্টি করাতে পারবো? পারবো। কিন্তু কথা হলো বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে। পদলেহনকারী হয়ে যে ক্ষমতা আঁকড়ে আছি তার শিকলে টান পড়বে। এই ভয়ে সৌদি আরবের শাসক থেকে শুরু করে মাহমুদ আব্বাসও নির্বিকার। হীরক রাজার গল্পের মতো, ‘রশি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।’ কেউ খান খান হতে চাচ্ছেন না। পেশি শক্তি আর মসি শক্তি বা জ্বালানী শক্তির দাপটে মধ্যেপ্রাচ্যের ভাইরাস খ্যাত ইসরায়েল কখনো মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস করার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। কিন্তু আমরা ফলাফল দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো যেখানে ইসরায়েল যুগের পরে যুগ ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী জনতার ওপর নির্বিচারে অমানবিক নিষ্ঠুর, পাশবিক নির্যাতনের ট্রেন বিরামহীন চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত বিবৃতি ও নিন্দা জ্ঞাপনের আত্মতুষ্টির ঢেকুর গিলছি। এতে বা কম কিসে! তবে এর করুণ পরিণতি একদিন মধ্যপ্রচ্যের প্রতিটি রাষ্ট্রকে ভোগ করতে হবে তা বোঝার জন্য কোনো বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
৩. জাতিসংঘ ও ভেটো ক্ষমতা
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে সারাবিশ্ব যে ধ্বংসলীলা ও প্রাণহানি দেখেছে তা থেকে বাঁচার জন্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জাতিপুঞ্জ। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা দেওয়াই ছিল যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু সেই পথে অন্যতম বাঁধা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে প্রস্তাব পাশ হওয়া সত্ত্বেও স্থায়ী সদস্যের যেকোনো একটা সদস্য রাষ্ট্রের ভেটো প্রদানের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষিত হয়ে যায়। এই ভেটো ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স ও রাশিয়া। যার দরুণ গত সপ্তাহে বর্বর হামলা চালানোর পরও আমেরিকার বিরোধিতার কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে একটা নিন্দা প্রস্তাবও পাশ হয়নি। অথচ ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেসামরিক এলাকায় একটি হাসপাতালে বিমান হামলা চালিয়ে একসাথে পাঁচশত নাগরিককে হত্যা করেছে যা যুদ্ধাপরাধ। এই অন্যায়ের বিচার হওয়া উচিত ছিল জাতিসংঘের আদালতে। অবাক করা বিষয় হলো- জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ফিলিস্তিনের নাগরিকদের ওপর মানবিক আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে নিজেই পশ্চিমাদের তোপের মুখে পড়েন। ভেটো নীতির এ সনাতন প্রথা জাতিসংঘকে শুধু অকার্যকরই করেনি বরং পশ্চিমাদের একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করেছে। এ নীতির সংস্কারে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে আর সোচ্চার হওয়া উচিত।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের যে সংজ্ঞা ও সনদ বাস্তবায়িত হয়েছে তার আলোকেই কার্যকর মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করাই প্রতিটি রাষ্ট্র ও নাগরিক দায়িত্ব। জাতিসংঘ সনদে এমনটাই বলা আছে। কিন্তু সেই জাতিসংঘের ভূমিকাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। জাতিসংঘের জন্মই হয়েছিল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মহান দায়িত্ব নিয়ে। জাতিসংঘ আজ তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিন, গাজা, পশ্চিম তীর আল আকসার শান্তি ও নিরাপত্তা আজও ফিরিয়ে দিতে পারেনি। নেই কোনো দৃশ্যমান স্থায়ী সুরাহা। এক্ষেত্রে বিখ্যাত দার্শনিক ভলতেয়ারের কথাটি সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলে ছিলেন ‘তোমার মতামত আমি গ্রহণ নাও করতে পারি বা গ্রহণ করব কিনা সেটা আমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া আমার দায়িত্ব, প্রয়োজনে আমার জীবন দিয়ে হলেও তোমার সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আমার কর্তব্য।’ ভলতেয়ারের সেই কথা এখন শুধু টেক্সটবুকে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যার ভুক্তভোগী সব সময় সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের দুর্বল শ্রেণি।
৪. যেমন চলছে আমেরিকার মানবাধিকার ও গণতন্ত্র
গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র নামে পৃথিবীতে যে দুটি বলয় রয়েছে তার একটি হলো ‘পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাসী অপরটি হলো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী।’ পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে পশ্চিমা বলয় রয়েছে তার মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সমাজতন্ত্রের বলয়ের মোড়ল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন যার বর্তমান রূপ রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে যার ফলে ১৯৪৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধ চলে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের ফলে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটলে তা পুঁজিবাদী বলয়কে আরও শক্তিশালী করে তোলে সেই সাথে মার্কিন মিত্র ও তার বলয় সর্বত্র আরও বিস্তৃত হয়। সৃষ্টি হয় এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা যেখানে সর্বত্র পুঁজিবাদের জয়জয়কার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বর্তমানে সারাবিশ্বে তাদের পররাষ্ট্র নীতির এজেন্ডা হিসেবে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’কে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বে এটা সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। কিন্তু সেই নীতি কি সকল রাষ্ট্রের জন্য সমান? নাকি যেখানে যে রকম স্বার্থ সেখানে সেরকম প্রয়োগ হবে? সেই নীত কি পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরান, বাংলাদেশ, ফিলিস্তিনির গাজা, পশ্চিম তীর, জেরুজালেমসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মুসলিম দেশের প্রতি এক আর অন্যত্র আলাদা? আমেরিকা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে সেখানে প্যালেস্টাইনের প্রতি ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে কেন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে? আসল কথা হলো- ইন্দোপ্যাসিফিকের ভূরাজনীতি, মধ্যপ্রাচ্যের তেল নীতি আর ইউরোপের ন্যাটোনীতির ওপর আমেরিকার মানবাধিকার নীতির সংজ্ঞা ভিন্ন ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী যে রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল ঠিক তেমন হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত ইসরায়েল। গাজায় প্রতিদিন শতশত প্রাণহানি ঘটছে সেখানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাহেব সন্দেহ প্রকাশ করেছেন প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে। অথচ তার প্রথম দায়িত্ব ছিল হামলা বন্ধের জন্য ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করা এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু সেখানে ন্যূনতম কোনো প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ নেই।
৫. আগামীর বিশ্ব বহুমেরুর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত নীতির যে পরাজয় হয়েছে ঠিক তেমনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্কের হাত ধরে মার্কিন নীতিরও পরাজয় দেখতে পাবে আগামী বিশ্ব। মানবাধিকার কোনো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকার নয় বরং মানবাধিকার হলো সম্মান ও নিরাপত্তার অধিকার। সেই সাথে এটা এক ধরনের প্রাকৃতিক ও সামাজিক অধিকার। আর মানবাধিকাররে দোহাই দিয়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তার কথা বলে ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করা, হত্যার মতো যে মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব; আর যাইহোক এটা মানবাধিকারের দৃষ্টান্ত হতে পারে না। আগামীর বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থায় পশ্চিমা আগ্রাসী নীতির বিলুপ্ত ঘটে একটি সাম্য ও ন্যায়সম্মত পৃথিবী প্রতিষ্ঠার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যা খুব বেশি দূরে নয়। সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলঙ্কজনক বিদায়, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা তারই উদাহরণ।
লেখক: মিজানুর রহমান,
সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
© 2023 | All Right Reserved | Developed By WebGet